আবদুস ছালাম খান
১৯৬৮ সালে ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ (পরে বঙ্গবন্ধু) আসামীরা গ্রেফতার হলে সারা দেশের ন্যায় লোহাগড়ার সচেতন মহলেও বেশ হৈচৈ পড়ে যায়। যদিও সে সময়ে রাজনীতির এত সব কিছু আমাদের মত ছোটদের জানার সুযোগ ছিল না। গ্রামে কোন কোন বাড়িতে রেডিও থাকলেও টেলিভিশন তখন ছিল না। সংবাদপত্রেরও তেমন প্রচলন ছিল না।
কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যেগে সংবাদপত্র আনলেও তা পাওয়া যেত একদিন বা দুইদিন পরে। ফলে আমাদের মত সাধারণ পরিবারের ছোটদের জন্য ঢাকার রাজনীতি জানা বা শোনার কোন সুযোগ ছিল না। তবে সে সময়ে আমাদের স্কুলের মাঠে রাজনৈতিক মিছিল-বক্তৃতা শুনে ঢাকার রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা পেতাম। তাছাড়া আমাদের স্কুলের দুই একজন শিক্ষকরা ক্লাসে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে ঢাকার আন্দোলনের কথা বলতেন।
বিশেষ করে ওই মামলায় লেঃ মতিয়ার রহমান নামে লোহাগড়ার একজন নৌবাহিনীর অফিসার আসামী হওয়ায় আমাদের স্কুলের স্যারদের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা হতো। সে সময়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের সামরিক আদালতে বিচার শুরু হয়। কিন্তু ওই মামলায় আসামীদের প্রহসনমূলক বিচারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী তীব্র গণ আন্দোলন শুরু হয়। যা ‘উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থান’ নামে পরিচিত। গণ অভ্যুত্থানের এক পর্যায়ে আইউব খান শেখ মুজিবুর রহমান সহ ওই মামলার সকল আসামীদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। আন্দোলনের এক পর্যায়ে আইউব খান নিজেও ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হবার পরদিন সকালে স্কুলে গেলে আমার একজন সহপাঠি আমাকে জিজ্ঞাসা করলো বলতো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নাম কি ? আমি আইউব খানের নাম বলতেই সবাই হেসে উঠলো। তখনই জানলাম প্রেসিডেন্ট পদের এই পরিবর্তনের কথা।
ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবার পর শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার আন্দোলন থামানোর আরেক কৌশল। তিনি সাধারণ নির্বাচন দিতে চাইলেন। আওয়ামীলীগ সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে রাজী হলেন। কিন্তু তৎকালীন সময়ের বৃহৎ রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ সহ কয়েকটি দল ‘ভোটের আগে ভাত চাই ’শ্লোগান দিয়ে নির্বাচন বর্জন করলেন। ইতোমধ্যে বিশ্ব কম্যুনিস্ট রাজনীতির বিভাজনে ন্যাপ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। যা কম্যুনিস্ট বিশ্বে চীন ও রাশিয়ার তাত্ত্বিক দ্বন্দ বলে পরিচিতি পায়। আমাদের দেশে ছাত্র রাজনীতিও সেই দ্বন্দে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। তৎকালীন সময়ের শীর্ষ দুই ছাত্রনেতার নামে এই দুই অংশের নামকরণ করা হয়।
চীন পন্থী অংশের নেতৃত্ব দেয়া নেতা রাশেদ খান মেননের নামানুসারে নামকরণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রুশপন্থী অংশের নেতা বেগম মতিয়া চৌধুরির নামানুসারে নামকরণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)। ন্যাপের দুই অংশের নাম হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাষানী) ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফ্ফর)।
রাজনীতির এই ডামাডোলের সময়ে আমাদের স্কুলের পাশে অর্থ্যাৎ কিরণ মুচির ঘরে ন্যাপের ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের অফিস ছিল। তখন লোহাগড়া স্কুলের সামনে আমাদের ঘরে ডাঃ সত্যেন আদিত্য নামে একজন এমবিবিএস ডাক্তারের চেম্বার ছিল। তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মোজ্জাফ্ফর) নেতা ছিলেন।
গণ অভ্যুত্থানের এই সময়ে তার ব্যবস্থাপনায় লোহাগড়া স্কুল মাঠে তৎকালীন সময়ে ‘অগ্নিকন্যা’ নামে পরিচিত বেগম মতিয়া চৌধুরী (বর্তমানে আওয়ামীলীগের এমপি এবং সাবেক মন্ত্রী) বক্তৃতা করতে আসেন। ওইদিন আমি বাজারে এসে ওই নেতার লোহাগড়া উপস্থিতির কথা শুনে দ্রুত ডাঃ সত্যেন আদিত্যের চেম্বারের সামনে যাই। তখনও নেতার আগমনকে স্বাগতঃ জানিয়ে শ্লোগান চলছিল। আমি অন্যান্যদের সাথে মিশে ভীড়ের মাঝে একটা প্রাইভেট কারে বসা অগ্নিকন্যা বেগম মতিয়া চৌধুরী কে দেখেছিলাম। ওটা ছিল আমার প্রথম কোন সরকার বিরোধী কেন্দ্রীয় নেতা দেখা। তবে এর আগে অবশ্য (১৯৬৭ সালে) আমাদের স্কুলের মাঠে আসা তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী খান এ সবুর কে দেখেছিলাম। আমরা লোহাগড়া স্কুলের ছাত্র হিসাবে নদীর ঘাট থেকে স্কুল পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ছিলাম। আমি ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র হিসাবে লাইনের সামনের দিকে অর্থ্যাৎ নদীর ঘাটের কাছাকাছি ছিলাম।
গণ অভ্যুত্থানের সময়ে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা এবং ছাত্রলীগের ১১ দফার পক্ষে জনমত তুঙ্গে। এই ৬ দফা যে বাঙ্গালীর স্বাধীনতার এক দফা তা সেদিন সম্ভবতঃ পাকিস্তানীরা বুঝতে পারে নাই। বুঝতে পারলে হয়তো ওরা সেদিন নির্বাচন দিত কি-না সন্দেহ। ওরা হয়তো ভেবেছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের এই দেশে ধর্মের দোহাই দিয়ে মুসলিম লীগের বিজয় অর্জন সম্ভব হবে।
আমার পরিবারের কেউ রাজনীতি না করলেও আমি ব্যক্তিগতভাবে ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি সচেতন। তাই বরাবরই মিটিং-মিছিল শোনার আগ্রহ আমার ছিল। সে সময়ে একদিন স্কুলে এসে দেখলাম স্কুলের অনেক ছেলেরা বড়দের সাথে নড়াইল যাচ্ছে।
বিষয়টি কী জানতে চাইলে ওরা বললো নড়াইলে ছাত্রলীগের সম্মেলন। ইচ্ছা করলে বিনা খরচে আমিও ওদের সাথে যেতে পারি। সব কথা শুনে আমার খুব আগ্রহ হলো। ওদের সাথে নড়াইল গেলাম। সম্মেলনে দুপুরে আমাদের ডাল-ভাত খাওয়ানো হলো। বাড়ি ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। সম্মেলনে কে কি নেতা হলো তা আমার মনে নেই। তবে যতদুর মনে আছে মহিশাহপাড়ার ছেকেন ভাই (প্রয়াত আবুল হোসেন ছেকেন) ও আড়িয়ারার মফিজ ভাই (প্রয়াত ফকির মফিজুল হক) নেতা হিসাবে আমাদের বেশ খোঁজ-খবর রেখেছিলেন। সম্ভবতঃ সময়টা হবে ১৯৭০ সাল। এর আগেই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে আইউব খানের পতন হয়েছে। তার জায়গায় ইয়হিয়া খান সামরিক প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হয়েছেন।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। সে সময় আমাদের নির্বাচনী এলাকা নড়াইলের প্রার্থী ছিলেন জাতীয় পরিষদে এ্যাডঃ খোন্দকার আবদুল হাফিজ এবং প্রাদেশিক পরিষদে লেঃ মতিয়ার রহমান। নির্বাচনে আমি ভোটার ছিলাম না। তথাপি ভোটের দিন আমাদের ভোট কেন্দ্র কুন্দশী মঙ্গলহাটা প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে সকাল সকাল হাজির হয়ে যাই।
কিন্তু ভোট কেন্দ্রে পুলিশ ও আনছারদের তৎপরতা দেখে প্রথম প্রথম একটু দুরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। ভোট কেন্দ্রে কোন বিশৃংখলা ছিল না। কারণ প্রতিপক্ষে তেমন জোরালো কোন তৎপরতা ছিল না। ভোট কেন্দ্রে সকলের মুখে একই কথা এইবার নৌকা মার্কায় ভোট দিলে আমরা স্বাধীন হয়ে যাব। সবকিছু সস্তায় পাওয়া যাবে। বিশেষ করে কাগজের দামের বিষয়টা নিয়ে সহজ আলোচনা ছিল। কারণ পূর্ব পাকিস্তানে তখন প্রতি দিস্তা কাগজের দাম ১২ আনা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ওই কাগজের প্রতি দিস্তা ৬ আনা। সহজ ভাষায় মূল্য বৈষম্যের এই কথাটি আমাদের বুঝতে সহজ হতো। ‘স্বাধীনতা ’ শব্দটি ছোটদের বোঝার জন্য কঠিন হলেও দ্রব্যমূল্য বৈষম্যের কথাটি আমাদের বেশি করে মনে ধরেছিল। -(লেখক সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক এবং সভাপতি লোহাগড়া প্রেসক্লাব)।