আবদুস ছালাম খান
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন পায়) পর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে গড়িমিশি শুরু করায় বঙ্গবন্ধুসহ নেতৃবৃন্দ নিশ্চিত হয়েছিলেন পাকিস্তানীদের সাথে শসস্ত্র যুদ্ধ ছাড়া তারা ক্ষমতা হস্তন্তার করবে না।
তাই বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে সুস্পষ্টভাবে ঘোষনা করেছিলেন ‘প্রত্যেক গ্রামে,প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’। লোহাগড়ার আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দও পূর্বাহ্নেই পাকিস্তানীদের মনোভাব বুঝতে পেরেছিল। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ মিঞা আগেই লোহাগড়া এসে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে সকলকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। তিনি লোহাগড়ায় এসে অধ্যক্ষ ওয়াহিদুর রহমানের বাসায় থাকতেন এবং ওই বাসায় ওয়াহিদুর রহমান, শা. ম. আনয়ারুজ্জামান, ওলিয়ার রহমানসহ আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে ওই মুহুর্তে করণীয় বিষয় অর্থ্যাৎ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতেন। তিনি তাঁর উচু পর্যায়ের সার্কেলের মাধ্যমে ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখতেন। একারণেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর পরই লোহাগড়ায় আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় এবং লোহাগড়া হাই স্কুল মাঠে ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়।
সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সভা-সমাবেশ ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে আহবান জানাতে থাকেন। এ প্রসঙ্গে শা ম আনয়রুজ্জামান তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধে লোহাগড়া’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ইয়াহিয়া খানের সাথে শেখ মুজিবের আলোচনা যে ফলপ্রসু হবে না এটা লোহাগড়ার নেতৃবৃন্দ আগেই অনুমান করেছিলেন। তারা আরো বুঝেছিলেন যে পরিস্থিতি বাঙালীদের একটা স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
সেজন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসাবে জনাব নুর মোহাম্মদ মিঞা, মুন্সি আতিয়ার রহমান ,মুন্সি শামসুল আলম ও আমার নেতৃত্বে মার্চের ১০/১২ তারিখ থেকে প্রতিরোধ বাহিনী তথা মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করে প্রাথমিক ট্রেনিং দেওয়া আরম্ভ হ’ল ’। ইতনা ইউনিয়ন সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ও ইতনা হাইস্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক আ জ ম আমিরুজ্জামান তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধে আমি ’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে লোহাগড়া থানার বিভিন্ন অঞ্চলে জনগনকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আমরা সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম’।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কয়েকদিন পরই মল্লিকপুর প্রাইমারী স্কুল মাঠে এমনই একটি জনসভার আয়োজন করা হয়। অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ মিঞা ওই জনসভার প্রধান অতিথি ছিলেন। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে অন্যান্যদের সাথে ওই জনসভা শুনতে গিয়েছিলাম। নুর মোহাম্মদ মিঞার বাড়ি আমাদের পাশের গ্রাম মহিশাহপাড়ায় হলেও আমি এর আগে কখনও তাঁকে দেখিনি। তবে ওইদিন সভার শুরুতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের রেকর্ডকৃত ভাষণ মাইকে বাজিয়ে শোনানো হয়।
লোহাগড়া বাজারের চিত্ত রায় নামক একজন কাপড় ব্যবসায়ীর পুরাতন একটি রেডিও ক্যাসেটে এই ভাষণ রেকর্ড করা ছিল। রেডিওটি মাইকের সামনে ধরে ভাষণটি বাজিয়ে শোনানো হয়। উল্লেখ্য তৎকালীন সময়ে আজকের মত ঘরে ঘরে রেডিও-টেলিভিষণ না থাকায় অনেকেই ওই ভাষণ প্রচারের সময় শুনতে পায় নি। সরাসরি শুনতে না পারাদের মধ্যে আমিও একজন। সংগ্রাম পরিষদে আওয়ামীলীগের তৎকালীন সভাপতি ইতনার সরদার তসলিম উদ্দিন, লোহাগড়া কলেজের অধ্যক্ষ ইতনার ওয়াহিদুর রহমান, লোহাগড়া হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক (পরে লোহাগড়া কলেজের অধ্যক্ষ) শা. ম. আনয়ারুজ্জামান, লোহাগড়া কলেজের শিক্ষক শেখ ওলিয়ার রহমান, আমডাঙ্গার সৈয়দ রোস্তম আলী, ঘাঘার মাহাবুবুল আলম (বাবু বিশ্বাস)ইতনা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আ.জ.ম আমিরুজ্জামান, যোগিয়ার আবুল বাশার, লোহাগড়ার মুন্সি আতিয়ার রহমান, ডিগ্রিরচরের শেখ বজলার রহমান (লাল মিয়া) উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরাও সংগ্রাম পরিষদ ও ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন। তাদের মধ্যে লাহুড়িয়ার চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান (মাখন), জয়পুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুর রউফ সরদার,লোহাগড়ার মুন্সি আতিয়ার রহমানের নাম উল্লেখযোগ্য। তবে শেষোক্ত তিন জনকেই পরবর্তীতে নকশালপন্থীরা গুলি করে হত্যা করে। মার্চ মাসের প্রথমার্ধেই এই ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করা হয়।
আমডাঙ্গা গ্রামের শামসুল আলম (যিনি আলম নামে পরিচিত ছিলেন) নামে একজন নৌবাহিনী সদস্য এই ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিতেন। তবে এই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহনকারীদের কোন অস্ত্র ছাড়াই প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। জয়পুরের সৈয়দ মনিরুজ্জামান নামে আমার একজন সহপাঠিকে আমি ওই ট্রেনিং ক্যাম্পে ট্রেনিং নিতে দেখেছি।
সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে ট্রেনিং ক্যাম্প খোলার কথা জানাতেই বিভিন্ন গ্রাম থেকে ছুটিতে আসা পুলিশ, মিলিটারী ইপিআর ও আনসার বাহিনীর সদস্যসহ এসব বাহিনীর অবসর প্রাপ্ত সৈনিক এবং স্কুল কলেজের ছাত্র-যুবকরা ট্রেনিং ক্যাম্পের সাথে যুক্ত হতে থাকে। ট্রেনিং ক্যাম্প চালুর কিছু দিনের মধ্যেই আনসার কমান্ডার লোহাগড়ার জিতু মিয়া, ইতনার নয়া মিয়া মঙ্গলহাটার আবদুর রাজ্জাক ও মহিশাহপাড়ার সিদ্দিকুর রহমানসহ আরো কয়েকজন ট্রেনার ট্রেনিং প্রদানের কাজে যুক্ত হয়।
উল্লেখ্য মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে অর্থ্যাৎ এপ্রিল মাসে কাশিয়ানী থানার রাতইল নিবাসী ক্যাপ্টেন দোহা ইতনা হাই স্কুলের মাঠে এবং আবদুর রউফ নামে একজন সেনা সদস্য তার দুই সহযোগী সৈনিক নিয়ে দিঘলিয়ায় একটি ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করেছিলেন। লেখা চলবে (লেখক সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক এবং সভাপতি লোহাগড়া প্রেসক্লাব।)