এ্যাডঃ আবদুস ছালাম খান
নড়াইল-লোহাগড়ার হাজার হাজার মুক্তিকামী জনতা যশোরের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সাথে মিলিত হয়ে পাকসেনাদের ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে আবরোধ করে ফেলতে সমর্থ হয়। ৩০ ও ৩১ মার্চ দুইদিন যশোর শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের (ইপিআর, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বাঙালী সৈন্যদের) সাথে পাকসেনাদের খন্ড খন্ড যুদ্ধে অনেক স্থানে হতাহতের পর পাকসেনারা শহর ছেড়ে ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে আশ্রয় নেয়। এসময় সম্পূর্ণ যশোর শহর অবরোধকারী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এই সুযোগে যশোর শহরবাসী নিরাপদে শহর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারে। যা ছিল মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে নড়াইল অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র সংগ্রহ পরিকল্পনার প্রথম উদ্দেশ্য। অর্থ্যাৎ পাকসেনারা যাতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে সাধারণ মানুষ হত্যা করতে না পারে। সেনানিবাসের পাকসেনাদের অবরোধ করে রেখে নিরিহ যশোরবাসীদের নিরাপদে শহর ছেড়ে আসতে দিতে পারায় সে পরিকল্পনা সফল বলা যায়। বলতে গেলে যশোর সেনানিবাসের মধ্যে পাকসেনাদের অবরুদ্ধ করে রাখার এ পর্বের নেতৃত্ব দেয় লোহাগড়া অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা। লোহাগড়া অঞ্চলের সাধারণ মানুষ যেভাবে এই প্রতিরোধ যুদ্ধে স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহন করেছিল তা আজকে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে।
মুক্তিযোদ্ধারা হাজার হাজার শসস্ত্র জনতাকে সংগে নিয়ে পায়ে হেঁটে গগন বিদারী ‘জয়বাংলা’ এবং ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ শ্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যায়। তাদের রাজপথ প্রকম্পিত করা শ্লোগান সড়কের দুই পাশের গ্রামবাসীদেরও যুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করে। মুক্তিকামী জনতার এই শ্লোগান মুক্তিযোদ্ধাদেরও প্রাণবন্ত করে তোলে। একারণেই পাকবাহিনী অবরোধ ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে যশোর শহর দখলের পর প্রথমেই নড়াইল অভিমুখে মার্চ করে। নড়াইল-লোহাগড়া অঞ্চলের মুক্তিকামী জনতার ঢাল-শড়কী নিয়ে যে স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহন তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গৌরবজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে।
নড়াইল জেলার দক্ষিণাঞ্চলের (এগারো খান এলাকার) একদল মহিলাদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনে উৎসাহিত করার পিছনে সংগ্রাম পরিষদ নেতাদের পাশাপাশি বামপন্থী রাজনীতিকদের উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রয়েছে। মুক্তিকামী জনতার প্রতিরোধ যুদ্ধে তারা স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহন করেছিল। লোহাগড়া থানার তালবাড়িয়া-কুমড়ি এলাকা থেকেও ঢাল-শড়কী নিয়ে অনেক মুক্তিকামী জনতা যশোরের প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।
৩১মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত যশোর সেনানিবাসের চতুর্দিক ঘিরে রাখা হয়। সকল গুরুত্বপূর্ণ পথে ব্যরিকেড বসানো হয় এবং ডিফেন্স তৈয়ার করা হয়।(তথ্য সূত্র- মুক্তিযুদ্ধে যশোর রণাঙ্গন’Ñ লেখক মেজর আবদুল হালিম)। এসময় পাকসেনারা ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। নড়াইল-লোহাগড়ার মুক্তিযোদ্ধারা নীলগঞ্জ ও ঝুমঝুমপুর ইপিআর ক্যাম্প পর্যন্ত পৌছে যায় এবং সেখানে অবস্থান নেয়। তবে যশোর অবরোধ প্রসঙ্গে যশোরের সাংবাদিক প্রয়াত শামসুর রহমান তার ‘৭১-এ যশোর মুক্তিযুদ্ধের এক অকথিত অধ্যায়’ নামক এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘৫এপ্রিল নড়াইল থেকে ২২ মাইল পশ্চিমে যশোর অবিমুখে শুরু হয় ‘যশোর মার্চ’। ঢাল, শড়কী, রামদা ও অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র ছাড়াও মার্চকারীদের কাছে ৫’শর মত আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। ৮ এপ্রিল মিছিলটি যশোর শহরের পূর্ব প্রান্তে ঝুমঝুমপুর ইপিআর ক্যাম্পের সন্নিকটে যায়। এখানে কয়েকশ’ বাঙালী অবাঙালী ইপিআর ছাড়াও ছিল কিছু পাকবাহিনীর সদস্য। এসময় ৫০ জন বাঙালী ইপিআর মিছিলকারীদের সাথে অস্ত্রসহ যোগ দেন। সামান্য গুলি বিনিময়ের পর পাকবাহিনী সেনানিবাসে চলে যায়। ক্যাম্পের পাশের বিহারী পল্লী থেকে গুলি ছোড়া হলে জনতা তাদের ঘেরাও করে। এতে দাঙ্গাকারী ও চিহ্নিত কিছু অবাঙ্গালী লুটেরা নিহত হয়।’
এসময় ঢাক-ঢোল ডাংখাসহ হাজার হাজার জনতা বাজনা বাজিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দেয়। পাকসেনারা ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে নিশ্চুপ অবরুদ্ধ হয়ে থাকায় মনে হতে থাকে যে কোন সময়ে তারা শ্বেতপতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিতে পারে। এসময় যশোর বিমান বন্দরে ঘনঘন বিমান ওঠানামা করতে দেখা যায়। সম্ভবতঃ এ সময় ওরা নতুন কোন অস্ত্র-শস্ত্র আমদানী করে শক্তি বৃদ্ধি করে।
টানা কয়েকদিন দিবারাত্র খেয়ে না খেয়ে ক্যান্টনমেন্ট অবরোধ করে রাখা হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী জনতা ক্লান্ত হয়ে পড়লেও সফলতার আনন্দে তারা ক্লান্তি ভুলে যায়। এসময় লোহাগড়া থেকে যারা প্রতিরোধ যুদ্ধে শামিল হয়েছিল তাদের ২/১ জন ফিরে আসতে শুরু করে। ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এই সফলতার সংবাদ শুনে আমরা বেশ উৎসাহিত হতে থাকি। তবে যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে খাদ্য ও পানীয় জলের সংকটের কথা জানায়। এ সময় লোহাগড়া স্কুলের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প থেকে যশোরে অবস্থানরত নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ রাখা সমস্যা দেখা দেয়। কারণ যশোর থেকে লোহাগড়ার পথে দুইটা নদী পার হতে হয়।
তাছাড়া তখনকার নদী তো আর এখনকার মত পানি শুন্য ছিল না। নেতৃবৃন্দ লোহাগড়া স্কুলের ক্যাম্পটিকে লক্ষিপাশায় স্থানান্তরের এবং যশোরে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য শুকনো খাবার ও ডাব নারিকেল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অধ্যক্ষ ওয়াহিদুর রহমান তাঁর ‘লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আমাদের মূল তৎপরতা ছিল যশোরের পথে সৈন্য অস্ত্র ও খাদ্য পাঠানো। এসডিও কামাল সিদ্দিকী নড়াইল থেকে নির্দেশ পাঠাতেন। আমরা চাহিদা অনুযায়ী রসদ ইত্যাদি পাঠাতাম। নড়াইলের সাথে টেলিফোন ও সড়ক যোগাযোগ সহজতর বিধায় আমাদের ক্যাম্প লোহাগড়া স্কুলের হেড মাস্টারের বাসা থেকে লক্ষিপাশা পোস্ট অফিসের সামনের আনসার ক্লাবে স্থানান্তর করা হয়’।
উল্লেখ্য লক্ষ্মিপাশা আনসার ক্লাবটি পরবর্তীতে লক্ষিপাশা ক্লাব নামকরণ করা হয়েছে। তবে লক্ষিপাশা ক্লাবের সাবেক সভাপতি শিক্ষক মুরাদ উদ্দৌলা ক্লাবটির তৎকালীন নাম ‘লক্ষিপাশা অফিসার্স রিক্রিয়েশান ক্লাব’ ছিল বলে দাবী করেন । মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত সেই ক্লাবটি এখনও সেখানে আছে।
আমাদের বাড়ির কাছের জুনাব খা নামে একজন আনসার সদস্য প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার নিতে। তার মাধ্যমে পাঠানোর জন্য গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে রুটি-গুড় ও ডাব নারিকেল সংগ্রহ করা হচ্ছে দেখে আমাদের বাড়ি থেকেও দুই কাঁধি (২০/২২ টা হবে) ডাব দেওয়া হলো। গ্রামের সকলেই স্বতঃস্ফুর্তভাবে এগুলি দিচ্ছে। কারোটা না নিলে সে যেন অখুশি হয়। সকলেই মনে করছে এ কাজে শরীক থাকা যেন তার নৈতিক দায়িত্ব।
এদিকে অবরোধকারীদের মধ্যে বিভিন্ন বাহিনীর সৈনিকের সাথে অধিকাংশই মুক্তিকামী জনতা। তারা সবাই একক কোন কমান্ডের অধীনে বা সুসংগঠিত ছিল না। তাছাড়া সেখানে খাবার বিতরণের অব্যবস্থাপনাও ছিল। আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সুসজ্জিত ও সুসংগঠিত সেনাবাহিনীর বিপরীতে শুধুমাত্র স্বাধীনতার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ আবেগ প্রবণ জনতার আবেগ কতক্ষণ ধরে রাখা যায়। তিনদিন অবরোধ করে রাখার পর অবরোধকারীদের সংখ্যা ক্রমে কমতে শুরু করে।
সম্ভবতঃ এ অবস্থায় পাকবাহিনীও মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা ও শক্তি আঁচ করতে পারে। তিনদিন অবরুদ্ধ হয়ে থাকার পর সুযোগ বুঝে বিকালে পাকবাহিনী ভারী অস্ত্র-শস্ত্র ব্যবহার শুরু করে এবং ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে। এসময় তারা পদাতিক বাহিনীর পাশাপাশি বিমান হামলাও চালায়। কিন্তু তাদের প্রতিহত করার মত প্রয়োজনীয় ভারী অস্ত্র না থাকায় অবরোধকারী মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
পাকবাহিনী পুনরায় যশোর শহর দখল করে নেয়। ৬ এপ্রিল পাক বিমান বাহিনীর দুটি জেট বিমান নড়াইল শহরে বোমা বর্ষণ করে। নড়াইল শহর জনমানব শুন্য হয়ে পড়ে। এতে মুক্তিবাহিনীর রসদঘাটিও বন্ধ হয়ে পড়ে। নড়াইল-লোহাগড়ার মুক্তিযোদ্ধারা যশোরের অবস্থান ছেড়ে দিলেও পাকবাহিনীর নড়াইলে আসতে বাধা দিতে নড়াইল যশোর রোডের দাইতলা ব্রীজে প্রতিরোধ ঘাঁটি করে। দুইদিন সেখানে টিকে থাকলেও লোহাগড়া থানার কোলা গ্রামের বশির আহমেদ নামে একজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ২ জন মুক্তিযোদ্ধা মারা যাওয়ার পর সে ব্যারিকেডও প্রত্যাহার করা হয়। কয়েকদিনের মধ্যে পাকসেনারা যশোর ও নড়াইল শহর দখল করে নেয়। লেখা চলবে…(লেখক সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক এবং সভাপতি লোহাগড়া প্রেসক্লাব)