মীর আব্দুল গণি, জার্মানি প্রবাসী
এ পর্যায়ে বর্তমান উন্নত বিশ্বে শিক্ষা শুরুর বয়স নির্বাচনের গুরুত্ব জানার চেষ্টা করব। বিশেষ করে জার্মানিতে শিক্ষা শুরুর বয়স নির্বাচনে কীরূপ গুরুত্ব দিয়ে থাকে তা আলোচনা করব। কারণ জার্মানির শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত তাই অনেক দেশ জার্মানিকে অনুসরণ করে থাকে।
জার্মানিতে শিক্ষা শুরু করা হয় কিন্ডারগার্টেনে।
অতএব কিন্ডারগার্টেন ব্যবস্থা আলোচনা করলে বয়স নির্বাচনের গুরুত্ব বুঝতে সহজ হবে। (কিন্ড (kind/er) জার্মান শব্দ, বাংলা শিশু একবচন/ কিন্ডার বহুবচন, (garten) গার্টেন অর্থ বাগান, (ইংরেজিতে day nursery) বাংলায় শিশু প্রতিপালণ কেন্দ্র বলা যায়।। উদ্ভাবক জার্মান নাগরিক ফ্রিডরিশ ফ্রবেল।)
শিশুদের ৩ বছর বয়স হতে ৬ বছর বয়স পর্যন্ত কিন্ডারগার্টেন বাধ্যতামূলক। (বছরের প্রথম ও দ্বিতীয়ার্ধে জন্মগ্রহণের কারণে কয়েক মাস বেশি হতে পারে।) ৩ বছর বয়স বাধ্যতামূলক হওয়াতে বুঝা যায় বয়স নির্বাচনে তাঁরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
গুরুত্ব দেওয়ার কারণ- জার্মানির কিন্ডারগার্টেন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলে গুরুত্ব দেওয়ার কারণ স্পষ্টই বুঝা যায়- মূলত পরিবারের বোধ-চেতনা উৎসারিত আচরণ উপলব্ধি অর্জনের পূর্বেই জন্মগত গুণহীনের মানসপটে কাঙ্ক্ষিত গুণের উন্মেষ প্রক্রিয়া শুরু করা। জার্মানির কিন্ডারগার্টেন ব্যবস্থার লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করলেই ব্যবস্থাটির উদ্দেশ্য বুঝতে সহজ হবে।
জার্মানির কিন্ডারগার্টেন ব্যবস্থার লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ: (১) ৩ বছর বয়সে কিন্ডারগার্ডেন বাধ্যতামূলক। (২) শিক্ষাদানে অনুসৃত পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া হলো : pedagogic (science of teaching) দর্শন, মনস্তাত্ত্বিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক শিক্ষাদান ব্যবস্থা। শিশুর মানসিক গঠন দানে দর্শন, মনস্তাত্ত্বিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণালব্ধ শিশু-লালন প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়। শিশুরা কখনোই বুঝতে পারে না যে, তাদের মানসপটে ভবিষ্যতের বিশেষ কাঙ্ক্ষিত মানসিক গঠন দান করা হচ্ছে।
(৩) কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের অক্ষর-জ্ঞান দেওয়া হয় না। খেলনা উপকরণ, আনন্দদায়ক খেলা ও বিভিন্ন উপায়ে ‘আচরণ সক্ষমতার আত্মবিশ্বাসের আনন্দ’ শিশুর মানসপটে জাগ্রত করে তোলা শুরু করা হয়।
(৪) কিন্ডারগার্টেনের শিশু প্রতিপালনকারীগণ মহিলা। জার্মানিতে যারা কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের যত্নে লালন করেন তাদেরকে কিন্ডার এরসিয়ারিন বলা হয়, শিক্ষক নয়। বাংলায় শিশু প্রতিপালনকারী বল্লে যথার্থ হবে।
জার্মানিতে কিন্ডাগার্টেনে যারা শিশু প্রতিপালন পেশা গ্রহণে ইচ্ছুক তাদের অধ্যয়ন জীবনের একটা নির্দিষ্ট পর্যায় হতে শিশু প্রতিপালন বিষয়ভিত্তিক অধ্যয়ন করতে হয় এবং শিক্ষা বিভাগ কর্তৃক প্রণীত শিশু-শিক্ষা-প্রক্রিয়ার ওপর অবশ্যই তাদের যথাযথ অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়।
শিশু প্রতিপালনকারীগণের অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব বুঝতে সহজ হবে যদি আমরা ফরাসি বীর সেনাপতি নেপোলিয়নের অমূল্য বাণীটির গুরুত্ব অনুধাবন করি।
বাণীটি হলো “আমাকে শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি দেব।” বাণীটিতে আদর্শ নাগরিক গঠনে শিক্ষিত মায়ের ভূমিকার অপরিহার্যতা বুঝানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- প্রতিটি ঘরে ঘরে শিক্ষিত মা পাওয়া সম্ভব নয়। এবং জাতি গঠনে শিক্ষিত মায়ের ভূমিকার বিকল্পও নেই। জাতি গঠনে শিক্ষিত মায়ের গুরুত্ব ও বাস্তবতা অনুধাবন করেই জার্মানি ও উন্নত বিশ্ব।
কিন্ডাগার্টেনের শিশু প্রতিপালনকারীগণকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে শিক্ষিত মায়ের বিকল্প রূপে গড়ে তুলে তাঁদের দ্বারা শিশুদেরকে কাঙ্ক্ষিত মানসিক গঠনদান করে থাকেন। উক্ত কারণেই যাঁরা শিশু প্রতিপালন পেশা গ্রহণ করেন বা গ্রহণ করতে আগ্রহী তাঁদেরকে শিশু প্রতিপালন বিষয়ে অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক করা হয় এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে শিক্ষিত মায়ের যোগ্য বিকল্প করে
তোলা হয়ে থাকে।
শিক্ষিত মায়ের বিকল্প হিসাবে গড়ে তোলাও সম্ভব।(কিন্ডাগার্টেনে শিশুদেরকে দিনে কয়েক ঘণ্টা শুধু কারও যত্নে রাখা উদ্দেশ্য, এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।)উদ্দেশ্য- বিকল্প-শিক্ষিত মায়ের দ্বারা শিশু সত্তায় কাঙ্ক্ষিত বোধ-চেতনার উন্মেষ সাধন করা। মূলত উক্ত উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠিত।
উপরিউক্ত আলোচনায় শিক্ষা শুরুর বয়স নির্বাচনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এবং কিন্ডাগার্টেন ব্যবস্থার উদ্দেশ্য অতি সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের মানসিক গঠনদানের বহু বাস্তব চিত্র উল্লেখ করা যায়।
সংক্ষিপ্ত একটি ঘটনাঃ শিশুটির বাবার মুখে শোনা। সবে কিন্ডারগার্টেন শেষ করে স্কুলে ভর্তি হবে। শিশুটিকে নিয়ে বাবা বাসে উঠেছেন একটি টিকিট করে। শিশুটি যদি বলে তার বয়স ৬ বছর হয়নি তবে তার টিকিট লাগবে না। বাবা শিশুটিকে বলছে, চেকার তোমাকে বয়স জিজ্ঞাসা করলে বলবে আমার বয়স ৬ বছর হয়নি।
জবাবে শিশুটি বলছে কেন? আমার বয়স ৬ বছর হয়েছে তো, আমি ৬ বছরই বলব। বাবা ও শিশুর কথা শুনে বাসের অন্যান্য যাত্রীরা কৌতূহল দৃষ্টিতে তাদের দেখছে। বাবা বুঝতে পেয়ে শিশুটিকে নিয়ে পরবর্তী স্টপেজে নেমে যান।
উল্লিখিত ঘটনাটি শিশুর মানসিক গঠনে এদেশের কিন্ডারগার্টেনের প্রতিপালন- কারীগণের ভূমিকা তুলে ধরে। যে শিশুটি কিন্ডাগার্টেন যাওয়া আরম্ভ করেছে সে আগ্রহসহ নিয়মিতই যেতে চায়। কখনোই তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয় না এবং অন্যায় ও অস্বচ্ছতা ঘৃণা করে এবং এড়িয়ে চলে। (জার্মানির কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতি গ্রহণ করতে আগ্রহী হলে সকল ব্যবস্থা ও পদ্ধতি যথাযথভাবে জেনে নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।) চলবে…(সূত্রঃ “গঠনমূলক আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা”) পূর্ব লেখাঃ
কী প্রকার শিক্ষাদান প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি জাতির মেরুদণ্ড গড়ে তোলে?