মীর আব্দুল গণি, জার্মানি প্রবাসী
আমরা ইতঃপূর্বে অবগত হয়েছি, শিক্ষার কাঙ্খিত মান পেতে হলে প্রক্রিয়াজাত শিক্ষা দ্বারা শিক্ষাদানের উপাদানসমূহের গুণগত ও পরিমাণগত মান নিশ্চিত করতে হয়। বাংলাদেশের শিক্ষাদান ব্যবস্থা প্রক্রিয়াজাত কি না তা জানার জন্য পূর্বোল্লিখত শিক্ষা-উপাদানের কয়েকটি তার পূর্বোল্লেখিত ক্রমানুসারে পুন:রায় সংক্ষেপে উপস্থাপন ও পর্যালোচনা করা হলো- উপাদানসমূহ যেমন- শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তা, শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য, শিক্ষাদান প্রক্রিয়া, শিক্ষার্থীর বয়স নির্বাচন এবং শিক্ষকের ব্যক্তি বৈশিষ্ট্য ও শিক্ষাদানে তার যোগ্যতার গুরুত্ব ।
উপাদানসমূহের পর্যালোচনা- শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তাঃ আমরা উল্লেখ করেছি যে, ব্যক্তির জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে এমন অনেক বিষয় আছে যা ব্যক্তির অস্তিত্বের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য জানা বা শেখা একান্ত প্রয়োজন। যে বিষয়সমূহকে আমরা ব্যক্তির মৌলিক শিক্ষা বলে উল্লেখ করেছি। এবং উল্লেখ করা হয়েছে ব্যক্তি নিজ থেকে মৌলিক শিক্ষার বিষয় নির্ধারণ ও শেখার গুরুত্ব অনুধাবনে অক্ষম। ফলে সুনির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায়, পর্যায়ক্রমে এবং শিক্ষাদানের একটা পর্যায়ে মৌলিক শিক্ষার বিষয়সমূহের শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে হয়। (হতে পারে কিন্ডারগার্টেন হতে ৮ম বা ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত সময়ের মধ্যে।) বাংলাদেশের শিক্ষাদান ব্যবস্থা লক্ষ করলে দেখা যায়- ব্যক্তির মৌলিক শিক্ষার বিষয়সমূহ নির্ধারিত নয় এবং শিক্ষাদানেও মৌলিক শিক্ষার বিষয়সমূহে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
পর্যালোচনা-শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যঃ আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি, শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য হলো- সত্তার স্বকীয় বোধ-চেতনার পরিবর্তন সাধন করে কাঙ্খিত বোধ-চেতনার উন্মেষ সাধন করা। যেমন আমরা বলি- শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। উক্ত ক্ষেত্রে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য হতে হবে- যে সকল মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধসমূহ জাতির মেরুদণ্ড গঠন করে সেই সকল মূল্যবোধসমূহ ব্যক্তি আচরণে যথাযথ উন্মেষন সাধন করা। যার একমাত্র উপায় হলো প্রক্রিয়াজাত শিক্ষাদান ব্যবস্থা।
বাংলাদেশের শিক্ষাদান ব্যবস্থা লক্ষ করলে দেখা যায়- উক্ত মূল্যবোধসমূহ উন্মেষ সাধনের যথাযথ প্রক্রিয়া শিক্ষাদান ব্যবস্থায় গ্রহণ ও অনুসরণ করা হয় না।
পর্যালোচনা– শিক্ষাদান প্রক্রিয়াঃ এ পর্যায়ে উল্লেখ করতেই হয়, শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার মূল উদ্দেশ্যই হলো সঠিক শিক্ষাদান প্রক্রিয়া কী তা নিরূপণ করা। আমাদের আলোচনায় প্রাপ্ত শিক্ষাদান ব্যবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষাদান প্রক্রিয়া তুলনা করলে দেখা যায়- ব্যক্তির মৌলিক শিক্ষার বিষয় ও আচরণ গঠনের কোনো প্রক্রিয়াই গ্রহণ করা হয় না। শুধু প্রক্রিয়াহীন স্বাক্ষরতা বা পাঠদানের ওপর বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়। অতএব, উল্লেখ করা যায়, বাংলাদেশের শিক্ষাদান ব্যবস্থা প্রক্রিয়াহীন।
পর্যালোচনা– শিক্ষার্থীর বয়স নির্বাচনঃ পূর্বেই আলোচনা করেছি, শিক্ষার্থীর বয়স নির্বাচনের উদ্দেশ্য হলো (৩ হতে ৬ বছর বয়স পর্যন্ত) কিন্ডারগার্টেনে প্রশিক্ষিত তত্ত্ববধানকারীর (বিকল্প শিক্ষিত মায়ের) যত্ন ও লালন-পালনে শিশুর মানসিক ক্ষেত্রকে শিক্ষার উপযোগী করে তোলা। শিশুর মানসিক ক্ষেত্রকে শিক্ষার উপযোগী করে তোলার গুরুত্ব একটি উপমায় উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- সোনালি ফসলে গোলা ভরে তোলার জন্য রোপণ ও বপনের পূর্বে গুরুত্ব -পূর্ণ বিষয় হলো জমির প্রস্তুতি পর্ব। শিশুর যত্ন ও লালন-পালন হলো তেমনি শিক্ষাদানের প্রস্তুতি পর্ব যা অত্যান্ত সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া নির্ভর। শিক্ষার্থীর বয়স নির্বাচন ও শিশুর মানসিক গঠনদানের প্রক্রিয়াগত গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে যদি জার্মানির গৃহীত শিক্ষাদান ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করা হয় তবে দেখা যায়-
বাংলাদেশে শিক্ষাদান প্রক্রিয়া বা পদ্ধতিগত দিকে ব্যাপক অপূর্ণতা রয়েছে।
যেমন- (ক) শিক্ষার্থীর বয়সময় অনুসারে আচরণ গঠনের কোনো প্রক্রিয়া ও শিক্ষাদানের বিষয়ে বিশেষ করে ব্যক্তির মৌলিক শিক্ষার বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। শুধু পাঠদান বা স্বাক্ষরতা অর্জনের ওপরই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে।
(খ) শিশুদের মানসিক গঠনদানে দর্শন, মনস্তাত্ত্বিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক প্রক্রিয়া যথাযথ গ্রহণ করা হয় না। (গ) বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেনে শিশু প্রতিপালনকারীদের যথাযথ প্রশিক্ষণে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। (ঘ) বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেন শুধু ব্যবসাভিত্তিক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত। কর্তৃপক্ষ হয়তো পদ্ধতি/প্রক্রিয়া জানেন না অথবা অনুসরণ করার গুরুত্ব অনুধাবন করেন না। এবং শিক্ষা অধিদপ্তর বা যথাযথ কর্তৃপক্ষ তেমন কোনো নজরদারি রাখেন না বা প্রয়োজন মনে করেন না।
পর্যালোচনা– শিক্ষাদানে শিক্ষকের যোগ্যতা ও তার মূল্যায়নঃ শিক্ষকের যোগ্যতা বলতে শিক্ষাদানের যে সক্ষমতা বুঝায় আমরা এ সম্বন্ধে ইতঃপূর্বে উল্লেখ করেছি। উন্নত দেশের শিক্ষকদের যোগ্যতা ও তাঁদের মূল্যায়নের সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষকদের মূল্যায়নের তুলনা করলে নিম্নলিখিক বিষয়সমূহের ব্যাপক অপূর্ণতা দেখতে পাওয়া যায়।
যেমন– (ক) যারা শিক্ষকতা পেশা গ্রহণে ইচ্ছুক বাংলাদেশে তাদের শিক্ষকতা বিষয়ের উপর অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক করা হয় না। (খ) কারিগর শব্দটি শিক্ষাদানের প্রক্রিয়াগত দিকে শিক্ষকের যে রূপ বিশেষ দক্ষতার গুরুত্ব তুলে ধরে শিক্ষককে তদ্রূপ দক্ষ করে তোলার যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বাংলাদেশে গ্রহণ করা হয় না। (পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, বাস্তবতার আলোকে স্বীকার করতেই হবে যে, একজন মানুষ যখন শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করেন তখন তিনি মানুষ গড়ার সকল জটিল কলাকৌশল জানেন এমন নিশ্চয়তা দান করে না।)
(গ) বাংলাদেশে শিক্ষকের পারিশ্রমিকের পরিমাণ লক্ষ করলে দেখা যায়, সম্মানজনক ও মানসম্পন্ন জীবনযাপনের উপযোগী নয়। উক্ত কারণে শিক্ষাদানে শিক্ষক যথাযথ মনোনিবেশ করতে পারেন না বা করেন না। উল্লিখিত আলোচনায় প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রক্রিয়াজাত শিক্ষার বৈশিষ্ট্য বা শর্ত ধারণ করে না। চলবে…পূর্ব লেখাঃ