মাহবুবুর রহমান তুহিন
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ উদযাপিত হবে বিশ্ব পর্যটন দিবস। জাতিসংঘের পর্যটন বিষয়ক সংস্থা ‘ইউএনডব্লিউটিও এ বছরের পর্যটন দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে। ‘Tourism for inclusive Growth’ -অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য পর্যটন। কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্বব্যাপী আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে তীব্র আঘাত হেনেছে। নাগরিকদের ঘরে থাকতে বাধ্য করেছে। ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পর্যটন শিল্প। লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার হয়েছে। অর্থনৈতিক অগ্রাযাত্রা থমকে গেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। করোনার আঘাতে বেশি পর্যুদস্ত হয়েছে উন্নয়নশীল দেশসমূহ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। আশার কথা হলো, করোনার প্রকোপ কমে আসায় পৃথিবী আবার সচল হতে শুরু করেছে। আবার নতুন, আঙ্গিকে, নতুন উদ্দীপনায় মানুষ জীবনের আহ্বানে নিয়োজিত হচ্ছে। পর্যটনশিল্পও ধীরে ধীরে সচল হতে শুরু করেছে। ইউএনডব্লিউটিওর প্রত্যাশা সবাইকে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের দীপ্ত শপথে এবারের বিশ্ব পর্যটন দিবস উদযাপন পালন এক নতুন মাত্রা যোগ করবে।
অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার কৌতূহল মানুষের চিরন্তন। ‘থাকবোনাকো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগৎটাকে’ এ বোধে উদ্দীপ্ত মানুষ ঘর থেকে পা ফেলতে শুরু করে। সেই থেকে শুরু পর্যটনের পথচলা। সময়ের সাথে পৃথিবীর পথে চলতে চলতে পর্যটন বৃহৎ শিল্পে পরিণত হয়েছে এবং এই শিল্পের ক্রমবর্ধমান অগ্রযাত্রা বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টির বৈশ্বিক অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তন জনিত দুভোর্গের জন্য যখন শিল্পায়নকেও দায়ী করা হচ্ছে তখন বিশ্বে পরিবেশ বান্ধব সম্প্রসারণশীল হিসেবে বিকাশ হচ্ছে পর্যটন শিল্পের, যা টেকসই উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার।
অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। এর রূপে আকৃষ্ট হয়ে আবহমানকাল ধরে বিখ্যাত পরিভ্রাজকগণ এখানে ছুটে এসেছেন। বিখ্যাত পর্যটন ইবনে বতুতা, চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাং এ দেশের সৌন্দর্যের কথা তাঁদের গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য দূরীকরণে পর্যটনশিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই বর্তমান সরকার পর্যটনশিল্পের বিকাশের প্রতি গুরুত্বরোপ করেছে। জাতীয় শিল্পনীতি-২০১০ এ পর্যটনশিল্পকে অগ্রাধিকারমূলকখাত হিসেবে চিহ্নিতকরণ, জাতীয় পর্যটন নীতিমালা-২০১০ প্রণয়ন, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড প্রতিষ্ঠাসহ নানাধরনের উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে।
২০১৭ সালে বিশ্বের জিডিপিতে ট্যুরিজমের অবদান ছিল ১০.৪ শতাংশ যা ২০২৭ সালে ১১.৭ শতাংশে গিয়ে পৌঁছাবে। এছাড়া ২০১৭ সালে পর্যটকদের ভ্রমণখাতে ব্যয় হয়েছে ১৮৯৪.২ বিলিয়ন ডলার। আর একইবছর পর্যটনে বিনিয়োগ হয়েছে ৮৮২.৪ বিলিয়ন ডলার। পর্যটনকে বলা হয় একটি শ্রমবহুল ও কর্মসংস্থান তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। বর্তমানে পৃথিবীর ১০টি কর্মসংস্থানের মধ্যে একটি কর্মসংস্থান তৈরি হয় পর্যটনখাত। ২০১৭ সালে প্রায় ১১ কোটি ৮৪ লাখ ৫৪ হাজার কর্মসংস্থান তৈরি হয় পর্যটনখাতে। যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষখাত মিলিয়ে প্রায় ৩১ কোটি ৩২ লাখ। অর্থাৎ মোট কর্মসংস্থানের ৯.৯ শতাংশ তৈরি হয় পর্যটনখাতে। এছাড়া ২০১৭ সালে পর্যটকদের ভ্রমণখাতে ব্যয় হয়েছে ১৮৯৪.২ বিলিয়ন ডলার।
সারাবিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশ এ শিল্পে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটনশিল্পের অবদান ছিল ৮৫০.৭ বিলিয়ন টাকা। এ খাতে এই পর্যন্ত কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে ২৪ লাখ ৩২ হাজার। তাছাড়া, ২০১৭ সালে ৬ লাখের বেশি বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশে আসেন। একইবছর প্রায় ৪ কোটি দেশীয় পর্যটক সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ান। এতে দেখা যায় বিদেশি পর্যটন আগমন খুব বেশি না বাড়লেও অভ্যন্তরীণ পর্যটনের ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব হয়ে গেছে। এই বিপ্লবের ঢেউ বিদেশি পর্যটক আগমনকে আরো বৃদ্ধি করবে বলে সবাই আশাবাদী।
পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ এই দেশ মূলত হিমালয় অববাহিকার উর্বর পলল ভূমি সমৃদ্ধ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, বহ্মপুত্র, সুরমা, কুশিয়ারা নদীবিধৌত এ ভূমির ইতিহাস, অগ্রযাত্রা, সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক জাগরণে নদীর ভূমিকা বিশাল, বিরাট ও ব্যাপক। তাই নদী হতে পারে এ দেশের পর্যটনের অন্যতম স্পট। নদীগুলোকে ট্যুরিস্ট প্রোডাক্টে পরিণত করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
দেশের পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু পৃথিবীর দীর্ঘতম অভগ্ন, বালুকাময় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৭৮ কি. মি. মেরিন ড্রাইভের উদ্বোধন করেন। মেরিন ড্রাইভকে চট্টগ্রামের মিরেরসরাই পর্যন্ত সম্প্রসারণের কাজ চলছে। এটি বাস্তবায়িত হলে ব্যাপক সংখ্যক দেশি-বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট হবে আশা করা যায়। ফলে এ সেক্টরে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। রেল চলাচল শুরু হলে পর্যটকরা সহজে সুলভে এখানে আসতে পারবেন। । কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার কাজ চলছে। ২০১৫ সালে এর রানওয়ে ৬০০০ ফুট থেকে বাড়িয়ে ৯০০০ ফুট করা হয়েছে। পর্যটন এ নগরীর গুরুত্ব সময়ের সাথে বৃদ্ধি পাবার পরিপ্রেক্ষিতে এ বছরের ১৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী সমুদ্র থেকে ল্যান্ড ক্লেইম করে বিমানবন্দরের রানওয়ে আরো ১ হাজার ৭০০ ফুট বৃদ্ধির কাজ উদবোধন করেছেন। এর ফলে বোয়িং-৭৮৭ (ড্রিম লাইনার), বোয়িং-৭৭৭, বড়ো এয়ারবাস বিমানবন্দরে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে পারবে। ফলে পর্যটকরা সরাসরি এ পর্যটন নগরীতে আসতে সক্ষম হবে। এ ছাড়াও এই বিমানবন্দরে ফুয়েলিং স্টেশন নির্মিত হবে। ফুয়েলিং স্টেশন নির্মিত হলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যগামী উড়োজাহাজ এখান থেকে ফুয়েল নিতে ল্যান্ড করবে। এতে করে এটি একটি ট্রানজিট পয়েন্ট হয়ে উঠবে। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিমানের যাত্রীরা কক্সবাজারে বেড়ানোর সুযোগ পাবেন। এভাবেই কক্সবাজার আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক আকর্ষণে কক্সবাজারে তিনটি পর্যটন পার্ক তৈরির পরিকল্পনা করেছে সরকার। প্রতিবছর এতে বাড়তি ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ তিনটি ট্যুরিজম পার্ক হলো সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক।
রয়েল বেঙ্গল টাইগার খ্যাত সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সুন্দরবন অতুলনীয় ও জীববৈচিত্র্যে অসাধারণ। এটি শুধু বাংলাদেশের মানুষের কাছে নয়, বিশ্বের প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান। ৬ হাজার ১৭ কিলোমিটার আয়তনের এ বন লতাগুল্ম, ঘাস, গোলপাতাসহ ৩৫ প্রজাতির বৃক্ষ, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩২০ প্রজাতির পাখি, ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং ৪০০ প্রজাতির মাছের বিপুল বিচিত্র সম্ভার এ বন। সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। যথাযথ পরিচর্যা, পরিবেশবান্ধব পর্যটন ও ব্যাপক প্রচার এই বনকে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন স্পটে পরিণত করতে পারে।
পর্যটনের অপার সম্ভাবনার নাম বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল। যা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের মূল উপকরণ হলো পাহাড়ে ঘেরা সবুজ প্রকৃতি যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পর্যটকদের কাছে ধরা দেয়। এটি যেন ক্ষণে ক্ষণে প্রকৃতির রূপ বদলানোর খেলা। এখানে শীতে যেমন একরূপ ধরা দেয় ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে, ঠিক তেমনি বর্ষায় অন্য একরূপে হাজির হয়। শীতে পাহাড় কুয়াশা আর মেঘের চাদরে যেমন ঢাকা থাকে, তার সঙ্গে থাকে সোনালি রোদের মিষ্টি আভা। আবার বর্ষায় চারদিক জেগে ওঠে সবুজের সমারোহ। এ সময় প্রকৃতি ফিরে পায় আরেক নতুন যৌবন। বর্ষায় মূলত অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিস্টদের পদচারণা সবচেয়ে বেশি থাকে এ পার্বত্য অঞ্চলে।
বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের অপার সম্ভাবনা বিরাজমান। কিন্তু এ বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ শিল্প এখনও পিছিয়ে। এ জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা। একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরকে। দেশীয় পর্যটন বিকাশের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে প্রচারপ্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। পাশাপাশি এ শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। একজন পর্যটক দেশে আসা মানে ১১টি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়,পর্যটনের সাথে বিমান পরিবহণ, হোটেল, টুরিস্ট গাইড, ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেটর নানা ভাবে সম্পৃক্ত সুতরাং পর্যটন শিল্প ক্ষতি গ্রস্থ হলে অন্যগুলো অক্ষত থাকতে পারে না।
আশার কথা, পর্যটনশিল্পের বিকাশে সরকার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এটি বাস্তবায়ন হলে পর্যটনখাত হবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস। বিশ্ব একটি বই। যারা ভ্রমণ করে না তারা যেন এই বই এর শুধু একটা পৃষ্ঠা পড়লো। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘বিপুলা পৃথিবীর কতটুকু জানি, দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী’। দেখার জন্য ভ্রমণ। জানার জন্য ভ্রমণ। প্রবৃদ্ধির জন্য পর্যটন। লেখক – তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর (পিআইডি)