এ্যাডঃ আবদুস ছালাম খান
মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিয়ে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টি পি সি পি (এম এল) অর্থ্যাৎ নকশালরা নড়াইল-লোহাগড়া অঞ্চলকে ‘কৃষক রাজের এলাকা’ ঘোষণা দিয়ে তাদের দলীয় রাজনীতি কায়েম করতে সচেষ্ট হয়। পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের পাশাপাশি কৃষকরাজ কায়েমের তত্ত্ব হাজির করায় এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তারা পাক আর্মির বিরুদ্ধে লড়াইকে গৌণ হিসাবে ধরে নিয়ে ‘শ্রেণি শত্রু খতম’ করে কৃষক রাজের এলাকা কায়েমকে অধিক গুরুত্ব দেয়। জোতদার আখ্যা দিয়ে তথাকথিত শ্রেণী শত্রু খতমের নামে নীরিহ গ্রামবাসী ও অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদের হত্যা করে। ভূমিহীন কৃষকদের নামে গ্রামের ধনী কৃষকদের জমি দখল করে নেয়। যারা ভারতে গেছে তাদের জমির ফসল নিয়ে আসে। সে এক অরাজক পরিস্থিতি। সে অবস্থা না দেখলে কাগজে লিখতে গেলে কয়েকশ পাতায়ও কুলাবে না। নকশালরা জনগণের পাল্স না বুঝে তাদের পার্টির রাজনীতিকে মুখ্য হিসাবে প্রয়োগ করতে থাকে। তারা বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের আদর্শগত রাজনীতির ধারনাকে পরিবর্তন করার জোরালো পদক্ষেপ না নিয়ে কেবলমাত্র আওয়ামীলীগ নেতৃত্বের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তথাকথিত কৃষকরাজ কায়েমের ভ্রান্ত রাজনীতিতে নেমে পড়ে। অথচ বাংলাদেশের মানুষ তখন দখলদার পাকিস্তানীদের বিতাড়নই প্রধান কাজ হিসাবে মনে করে। ফলে নকশালদের সাথে এ দেশের মানুষের দুরত্ব বাড়তে থাকে। কৃষক পরিবারের অনেকেই তখন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে নকশালদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা দেশে ফিরে আসলে তারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আগে নকশাল উচ্ছেদের যুদ্ধে নামে।
জুলাই মাসের পর লোহাগড়ার মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিয়ে একে একে দেশে আসতে শুরু করে। এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিতে যেমন মাগুরা মহাকুমার পুলুম হয়ে ভারতে গিয়েছিল তেমনি ট্রেনিং শেষে একই পথে ফিরে আসতে থাকে। পুলুম তখন নড়াইল-লোহাগড়া তথা যশোর অঞ্চলের নকশালদের প্রধান ঘাঁটি। নকশালরা শরণার্থীদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদেরও ভারতে যেতে সাহায্য করে। আবার ফিরে আসার সময়ও নিরাপদে আসতে সাহায্য করে। নকশালদের দখলে থাকা লঞ্চে করে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌছে দিত।
মুক্তিযুদ্ধকালে নকশালদের ‘সেনাবাহিনী প্রধান’ কমরেড বিমল বিশ্বাস তার ‘উজান স্রোতের যাত্রী ’ বইতে লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালে আমাদের একটি লঞ্চে করে মুক্তিযোদ্ধাদের ঢাকা , মানিকগঞ্জ , বরিশাল ও বাগেরহাটে নিরাপদে পৌছে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা ভুমিকা রেখেছিলাম- এই সত্যকে অস্বীকার করে জনগনের লড়াইকে ছোট করা যৌক্তিকও নয় ,উচিৎও নয়’। তবে এ সময় একটি ভুল বুঝাবুঝিকে কেন্দ্র করে শরীফ খসরুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন মুজিব বাহিনীর একটি বৃহৎ দল পুলুমে নকশালদের হাতে আটক হয়। মুজিব বাহিনীর লোহাগড়া থানা কমান্ডার শরীফ খসরুজ্জামান ছাড়াও নড়াইল সদর থানা কমান্ডার শরীফ হুমায়ূন কবীর ও কালিয়া থানা কমান্ডার সরদার আব্দুল মজিদ এই দলে ছিলেন। পরে অবশ্য তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। তবে মুক্তিযোদ্ধদের অভিযোগ নকশালরা তাদের অধিকাংশ অস্ত্র রেখে দেয়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নকশালদের কথা থাকে কেউ কারো বিরুদ্ধে সংঘাতে না গিয়ে বরং যার যার সাধ্যমত পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করবে। কিন্তু আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে দলে দলে মুক্তিযোদ্ধারা দেশে ফিরে আসার পর থেকে তারা নকশালদের উপর চড়াও হতে থাকে। তাদের ভুমিকা দেখে মনে হতে থাকে নকশালদের নিশ্চিহ্ন করাই যেন তাদের মূল লক্ষ্য। এসময় তারা রাজাকারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরিবর্তে নকশালদের বিরুদ্ধে লড়াইকে অধিক গুরুত্ব দেয়। আলফাডাঙ্গা থানার হেমায়েত বাহিনী শালনগরে এসে হামলা চালিয়ে শাহাবুল ও মাহাবুল নামে দুই সহোদরকে হত্যা করে। নকশালরা তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে না গিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা তা প্রত্যাক্ষান করে। আগস্টের শেষ সপ্তাহে আড়িয়ারা স্কুলের ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল গন্ডবে অভিযান চালিয়ে নকশাল নেতা মমতাজকে বাড়ি থেকে ধরে আনে। তখন নকশালরা আলোচনার মাধ্যমে মমতাজের মুক্তির চেস্টা চালায়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা কোন আলোচনায় রাজী হয় না। দুইদিন পরে সিডি স্কুলমাঠে নকশাল নেতা মমতাজ ও তার সহযোগি দুলালকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। ঘোষণা দেয়া হয় ‘হাই কমান্ডের নির্দেশে নকশালদের খতম করা হচ্ছে’।
এ সময় কুমারকান্দার দাউদ সদলবলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পরে অবশ্য দাউদ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিশে মুক্তিযুদ্ধে দুঃসাহসী ও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। ২৭ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা নকশালদের মহিশাহপাড়া ঘাঁটি আক্রমণ করলে ঘাঁটি প্রধান রউপ পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও মর্জিনা নামে তার অন্যতম এক সহযোগীকে মুক্তিযোদ্ধারা নির্মমভাবে হত্যা করে। পরে অবশ্য রউপ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। ৩ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ ,আলফাডাঙ্গা ও লোহাগড়ার পাঁচশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নকশালদের লোহাগড়া থানার প্রধান ঘাঁটি লাহুড়িয়া আক্রমন করে। নকশালরা মুক্তিযোদ্ধাদের হটিয়ে দিতে সমর্থ হয়। ৬ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা নকশালদের যোগিয়া ঘাঁটি আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে নকশালদের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের পরাজয় হয়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার যোগিয়ার ইদরিছ মোল্যা শহীদ হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধা ইউনুস আলী নকশালদের ক্যাম্প কমান্ডার উজির আলীকে ধরে ফেলে। বাকীরা পালিয়ে যায়। ২৪ সেপ্টেম্বর শুক্রবার মুক্তিযোদ্ধারা অধিক শক্তি নিয়ে পুনরায় লাহুড়িয়া আক্রমণ করে। প্রায় ৫ ঘন্টা যুদ্ধের পর নকশালরা পালিয়ে শরুসুনায় চলে যায়। এ যুদ্ধে ২ জন নকশাল যোদ্ধা নিহত হয়। নকশালরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। নকশালদের প্রধান ঘাঁটি জয় করাকে এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বড় একটি বিজয় বলে মনে করে।
এদিকে ১২ অক্টোবর পাকবাহিনী নকশালদের সদর দপ্তর পুলুম আক্রমন করে। পুলুমে তখন ১২০০ নকশাল যোদ্ধা ছিল। কিন্তু পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে হালকা অস্ত্র নিয়ে টিকতে না পেরে ১৫ অক্টোবর সদর দপ্তরে অবস্থানকারী নেতারা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ে। এর একভাগ পেড়লির দিকে যায় এবং অপর ভাগ লোহাগড়ার শরুসুনায় চলে আসে। লোহাগড়ায় আসা নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন জেলা সম্পাদক শামসুর রহমান , সদস্য হেমন্ত সরকার , খবির উদ্দিন ,ও নড়াইল লোহাগড়া আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক শেখ আব্দুস সবুর। তবে এখানে এসে নকশালরা আর সংগঠিত হতে পারে নাই। কমরেড বিমল বিশ্বাস তার ‘উজান স্রোতের যাত্রী’ বইতে লিখেছেন, ‘বেঁচে থাকলে দেখা হবে’ এই শেষ কথা বলে ৩ নভেম্বর এক সংক্ষিপ্ত সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে পার্টি ভেঙ্গে দেয়া হয় ’। নকশালরা যে যার মত পালিয়ে যায় এবং বিভিন্ন সময় তাদের কাছে থাকা অস্ত্র জমা দিয়ে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে। তবে এর আগে কালিয়ার পেড়লিতে অবস্থানরত নকশালদের অপর অংশ ২৫ অক্টোবর রাতে বিমল বিশ্বাস ,নুর মোহাম্মদ সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে এক বৈঠকে বসে। সেখানে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে ‘বর্তমান সময় আতœরক্ষার সময়’ বলে পার্টি কর্মীদের আত্মগোপনের নির্দেশ দিয়ে পার্টির প্রকাশ্য অস্তিত্ব বিলুপ্ত করা হয়। (তথ্য সূত্রঃ ‘৭১-এ যশোর মুক্তিযুদ্ধের এক অকথিত অধ্যায় )।
প্রয়াত সাংবাদিক শামসুর রহমান তার ‘৭১-এ যশোর মুক্তিযুদ্ধের এক অকথিত অধ্যায়’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘শরুসুনায় আসা পার্টি বাহিনী ও নেতৃবৃন্দ মুজিববাহিনীর নড়াইল অঞ্চলের কমান্ডার শরীফ খসরুজ্জামানের সাথে আলোচনা করে। এর আগে আগষ্ট মাসে পুলুম এলাকায় ভারত থেকে আসার সময় খসরুজ্জামানের ইউনিটের লোকজন পার্টি বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছিলেন। একারণে পার্টি বাহিনী তাকে আটক করেও পরে ছেড়ে দেয়। আটককালে খসরুজ্জামান অঙ্গীকার করেছিল যে ভবিষ্যতে উভয় পক্ষ কোন সংঘাতে না গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে পাক বাহিনীর মোকাবেলা করবে। সে মোতাবেক ১৮ অক্টোবর বাবরায় এক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
এতে পার্টির পক্ষে শামসুর রহমা, খবির উদ্দিন ও শেখ আবদুস সবুর অংশ নেন। খসরুজ্জামান ছাড়াও তাদের পক্ষে অংশ নেন মুক্তিবাহিনীর লোহাগড়া থানার রাজনৈতিক প্রধান মতিয়ার রহমান বাদশা। সিদ্ধান্ত হয় পার্টি বাহিনী অস্ত্র জমা দেবে এবং পার্টি ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডে পার্টি বাহিনী পরিচালিত হবে। চুক্তি মোতাবেক পার্টি বাহিনী প্রায় তিনশ অস্ত্র জমা দেয়। কিন্তু পরে আর যৌথ কমান্ডে কোন বাহিনী গঠন করা হয়নি। বরং বিচ্ছিন্নভাবে তারা পার্টির সদস্য ও কর্মীদের হত্যা , বাড়িতে আগুন ও লুঠতরাজ করতে থাকে। অচিরেই পার্টির অনেক শীর্ষস্থানীয় সদস্য ও যোদ্ধাকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে’। লেখা চলবে। (লেখক সিনিয়র আইনজীবী এবং সাংবাদিক)