নিজস্ব প্রতিবেদক
নড়াইল পৌর শহরের আলাদাতপুরের ৫২’র ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী প্রায় ৯০ বছর বয়সী রিজিয়া খাতুন দীর্ঘ ৭০ বছরেও নিজ কর্মের স্বীকৃতি পাননি। এখন তিনি জীবনের অন্তিম সময় পার করছেন। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তার চাওয়া, ভাষা সৈনিক হিসেবে সরকারের স্বীকৃতি। কেবল তিনিই নন,তার পরিবারের সদস্যরাও একই দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট।
জানা গেছে, নড়াইল পৌরসভার ডুমুরতলা গ্রামের নুর জালালের মেয়ে রিজিয়া খাতুন বর্তমানে বসবাস করছেন শহরের আলাদাতপুর এলাকায়। স্বামী মৃত অ্যাডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক। তাদের চার ছেলে এক মেয়ের সংসারে এক ছেলে মারা গেছেন।
নিভৃতচারী ভাষা সৈনিক রিজিয়া খাতুন এখন বয়সের ভারে ন্যুজ্য হয়ে পড়ে চলাচলের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। জীবনের শেষ সময়টা এখন তার কাটছে বদ্ধ ঘরে। বিছানায় শুয়ে শুয়েই কেটে যায় দিন-রাত্রির পুরো সময়। বিছানাই যেন তার একমাত্র সঙ্গী। আর ভাষার মাসে সকলের কাছে তার কদর বেড়ে যায়। জেলা প্রশাসনসহ স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের আগে মাসজুড়েই ডাক পেলেও শারীরিক অক্ষমতার কারণে এখন আর কেউ তাঁর খোঁজ রাখেনা।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভাষা সৈনিকদের নামানুসারে বিভিন্ন সড়ক কিংবা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ অথবা বৃত্তি প্রদান করা হলেও এই ভাষাসৈনিককে নিয়ে সরকারি-বেসরকারি কোন উদ্যোগ এখনও দেখা যায়নি।
১৯৫২ সালের পর থেকে অনেক বারই ২১শে ফেব্রুয়ারি এসেছে। মানুষ শুধু শহিদদের কথাই স্মরণ করে। কিন্তু যারা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আজ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তাদের খবর ক’জন রাখে? তেমনই এক ভাষা সৈনিকের নাম রিজিয়া খাতুন।
১৯৫২ সালের শুরুর দিকের কথা। রাস্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উত্তাল ঢাকা। সেই উত্তাপে এবার ‘আঁচ’ লাগে সারাদেশে। ব্যতিক্রম হয়নি নড়াইলেও। চিত্রা নদী পারের এ জেলা শহরের তখন স্কুল পড়ুয়া তরুণীভাষা সৈনিক নড়াইলের রিজিয়া খাতুন। চাচার মাধ্যমে জানতে পারেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়েছে পুলিশ। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাওয়ায় ছিল তাদের অপরাধ। এ কথা শুনে ঠিক থাকতে পারেননি তিনিও। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে মিছিলে নামেন। ‘রাস্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ এ স্লোগানে মুখরিত করে তোলেন স্কুল পেরিয়ে শহরের রাস্তাতেও। গড়ে তোলেন শহীদ মিনার। শহীদদের স্মরণে ২২ ফেব্রুয়ারি পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন রিজিয়া খাতুনসহ অন্যরা।
স্থানীয়রা জানান, শহরের মহিষখোলা তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফসার উদ্দিন মোক্তারের বাড়িতে বৈঠক অনুষ্ঠিত হত। আফসার উদ্দিনের মেয়ে সুফিয়া খাতুন, তার ছেলে সে সময় ছাত্রনেতা শহীদ মিজানুর রহমান দুলু ও সুফিয়া খাতুনসহ অন্যরা বাড়িতে বিভিন্ন সময়ে গোপন বৈঠকে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি অন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ভাষার জন্য সেইসব সভা-সমাবেশে। ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করার কাজ করেন। ভাষার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে মিছিল-মিটিং তিনি ছিলেন সক্রিয়। তিনিসহ ১০-১৫ জন শহরের তৎকালীন কালিদাস ট্যাংক (বর্তমান টাউনক্লাব) এর পাশে প্রথম শহীদ মিনার তৈরি করে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। সরকারিভাবে সম্মান না মিললেও স্থানীয়রা রিজিয়া খাতুনকে ভাষা সৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন অনেক আগেই।
ঢাকার সঙ্গে ২২ ফেব্রুয়ারি নড়াইলেও শুরু হয় ভাষার জন্য আন্দোলন। সে দিনের ভাষা আন্দোলনে যোগ দিতে ছাত্ররা যখন রাস্তায় নামার জন্য ছাত্রীদের আহ্বান জানান তখন সবাই বিভিন্ন অজুহাতে পালিয়ে গেলেও ৩ জন যোগ দেন সেই দিনের মিছিলে। রিজিয়া খাতুন,সুফিয়া খাতুন ও রুবি।
ভাষা সৈনিক রিজিয়া খাতুনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তখনকার সময়ের টগবগে তরুণীর জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসেও অস্পষ্ট ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে ভালো কিছু বোঝা না গেলেও ইশারায় ঠিক বোঝালেন,ওপারের ডাকে সাড়া দেয়ার আগেই তিনি দেখে যেতে চান রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
ভাষা সৈনিক রিজিয়া খাতুনের ছেলে কামাল উদ্দিন রাসেল বলেন, ‘আমার মা ভাষা সৈনিক, এটা আদের গর্বের বিষয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে সময়ে রাজপথে আন্দোলন করেছে। মার শেষ ইচ্ছা ভাষা সৈনিক হিসেবে রাস্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়া। অথচ আজও রাস্ট্রীয়ভাবে তাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।’
এ প্রসঙ্গে নড়াইল জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন,‘ আমি এ জেলায় নতুন যোগদান করেছি। এ ভাষা সৈনিকের ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে তার সময়কার কারা কারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল সে ব্যাপারে খতিয়ে দেখব।’