গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি
পুরো নাম নাজমিন আক্তার কলি। পরিবারের লোকজন তাকে আদর করে কলি নামেই ডাকে। দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে কলি সবার বড়। কলির বাবা পেশায় একজন রাজমিস্ত্রির সহকারী। মা গৃহীনি। একমাত্র উপার্যনক্ষম দিনমজুর বাবার সামান্য আয়েই চলে পরিবারের খরচসহ তিন ভাই বোনের লেখাপড়া। চরম দারিদ্রতার মাঝে নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে বরাবরই শিক্ষা জীবনে ধারাবাহিক সাফল্য ধরে রেখেছে কলি। একজন শিক্ষার্থীর সফলতার পেছনে দারিদ্রতা কোনো বাধা নয়, এটা প্রমান করেছে কলি। অদম্য ইচ্ছা শক্তি দিয়ে দারিদ্রতাকে জয় করেছে এই মেধাবী শিক্ষার্থী। তিনি এবারের ঢাকা বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে ‘খ’ ইউনিটের মেধা তালিকায় ৩৭৪তম স্থান দখল করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার মইলাকান্দা গ্রামের মেধাবী কলির শিক্ষাজীবনে এ সাফল্যে পরিবারের লোকজনসহ খুশি এলাকাবাসী। কিন্তু এই খুশি আজ ম্লান হতে চলেছে। আর্থিক দৈন্যতার কারণে দরিদ্র এ মেধাবী শিক্ষার্থীটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। তাহলে কি টাকার অভাবে সৌরভ ছড়ানোর আগেই কি ঝরে যাবে কলি? এমন শঙ্কা বিরাজ করছে কলি ও তার পরিবারের লোকজনের মাঝে।
কলির বাবা ওয়াজিদুল ইসলাম ও মাতা জাহানারা বেগম জানান, কলি ছোট বেলা থেকেই লেখাপড়ায় খুব মেধাবী। সে ২০১২ সালের প্রাথমিক সমাপনি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ সহ টেলেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। পরে গৌরীপুর উপজেলার শ্যামগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৫ সালের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় জিপিএ-৫ সহ সাধারন গ্রেডে বৃত্তি পায়। একই বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান শাখায় ২০১৮ সালের এসসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। পরে অনলাইনে দেওয়া চয়েজ অনুযায়ী ময়মনসিংহ সরকারি মুমিন্নিসা কলেজে ভর্তির চান্স পায়। সেখানে ভর্তি হয়ে লেখা পড়ার খরচ চালাতে পারবে কিনা এই নিয়ে সন্দেহ থাকলেও ওখানেই সে ভর্তি হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিবারিক অক্ষমতার কারনে এক বছর যেতে না যেথেই সেখান থেকে ফিরে আসতে হয়। পরে স্থানীয় শ্যামগঞ্জ হাফেজ জিয়াউর রহমান ডিগ্রি কলেজে মানবিক শাখায় ভর্তি হয়ে ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ন হয়। এরপর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার মনো: বাসনা থাকলেও আর্থিক দৈন্যতার কারণে অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েন। সে সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় মানুষ মানুষের জন্য ও ঘুড্ডি ফাউন্ডেশন নামে দুটি বেসরকারী সংস্থা। তাদের সহযোগিতায় কলি ভর্তি প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। প্রস্তুতি শেষে চলতি শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধাতালিকায় ৩৭৪তম স্থান অধিকার করে কলি।
এত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও বাবা-মায়ের প্রেরণাই ছিল নাজমিন আক্তার কলি’র একমাত্র সম্বল। কলি জানান- পারিবারিক আর্থিক অনটনের মাঝেও আমি চেষ্টা করেছি ধারাবাহিক সফলতা ধরে রাখার। আমি ভালো ফলাফল করলে বাবা-মায়ের হাসিমুখই আমাকে প্রেরণা দিয়েছে আরো ভালো কিছু করার।
কলি বলেন- বাবার সামান্য আয়েই চলে তাদের পরিবার। ছোট বোন নাছরিন আক্তার মলি এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিবে আর ছোট ভাই জহিরুল ইসলাম ১০ম শ্রেণিতে পড়ছে। তাছাড়া মায়ের অসুস্থতা জনিত নিয়মিত ঔষধ কিনতে হয়। এতে করে অনেক কষ্ট করেই তাদের দিনাতিপাত করতে হয়। কলি লেখাপড়া শেষে ভবিষ্যতে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়ে দেশের সেবা করতে চায়।
আর্থিক দৈন্যতার কারণে এ মেধাবী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে লেখা-পড়ার খরচশেষ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারবে কিনা এ নিয়ে অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে। এ জন্য সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহবান জানিয়েছেন তার পরিবার।
শ্যামগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো: মিজানুর রহমান জানান, স্কুল জীবনে নাজমিন আক্তার কলি ছিল অত্যন্ত মেধাবী এবং বিনয়ী। সহপাঠীদের সাথে তার আচরণ ছিল প্রশংসনীয়। সে স্কুলে আসত নিয়মিত। তাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে এমন খবরে তারা খুব খুশি। তিনি আরও বলেন, শিক্ষাজীবন শেষে কলি ভালো একটা কিছু করতে পারবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।