৮৬ কিলোমিটার পথ বেশি পাড়ি দিয়ে রাজধানী থেকে বেনাপোলবন্দর হয়ে কোলকাতা যেতে হচ্ছে
সড়কটি চারলেনে উন্নতি হলে রাজধানীর সাথে বেনাপেল স্থলবন্দের দূরত্ব কমবে ৮৬ কিলোমিটার
স্টাফ রিপোর্টার
দেশের বৃহত ৬.১৫ কিলোমিটারের স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর রাজধানী থেকে বেনাপোল স্থল বন্দর হয়ে সড়ক পথে কোলকাতা যাওয়ার পথ অনেকটা সহজ হলেও ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল সড়ক চার লেনে উন্নতি করন না হওয়ায় খুলনা ঘুরে ৮৬ কিলোমিটার পথ বেশি পাড়ি দিয়ে রাজধানী থেকে বেনাপোলবন্দর হয়ে কোলকাতা যেতে হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের। এতে সময় ও অর্থ অপচয় হচ্ছে । সওজ বলছে ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল ১৩০ কিলোমিটার সড়ক চারলেনে উন্নতি করার জন্য ১১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছে সড়কটি চারলেনে উন্নতিকরণ করা হলে রাজধানী ঢাকার সাথে বেনাপোল স্থল বন্দরসহ ভারতের কোলকাতার যোগাযোগ অনেক সহজ হয়ে যাবে। এতে রাজধানীর সাথে বেনাপোল স্থল বন্দরের দূরত্ব কমবে ৮৬ কিলোমিটার। দ্রুত এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জোর দাবী জানিয়েছে ভুক্তভোগীসহ এলাকাবাসী।
জানাগেছে, রাজধানী ঢাকার সাথে বেনাপোল স্থলবন্দরসহ দেশের দক্ষিন পশ্চিম অঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেস ওয়ে আধুনিক রাস্তার কাজ শেষ হয়েছে বেশ আগেই। “ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়ককে ৪-লেনে উন্নীতকরণের জন্য ভূমি অধিগ্রহন ও ইউটিলিটি স্থানান্তর প্রকল্প” শীর্ষক প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহনের জন্য ভূমির মৌজা ভিত্তিক রেইট ও ভূমি অধিগ্রহন ব্যয় এবং অবকাঠামো, গাছপালা ইত্যাদির ক্ষতিপূরন ব্যয় প্রাক্কলন প্রেরন প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক (সওজ) সড়ক ভবন ঢাকা থেকে ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল এবং যশোর জেলা প্রসাশকের কাছে চিঠি দেন ২০২০ সালের অক্টোবর মাসের ১ তারিখে।
নড়াইল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহন শাখার কর্মকর্তা জেলা কানুনগু সিরাজুল ইসলাম জানান, “ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়ককে ৪-লেনে উন্নীতকরণের জন্য নড়াইল অংশে ৩২টি মৌজায় ২শত ৭৪ একর জমির সম্ভাব্য ব্যায় প্রায় ২হাজার কোটি টাকা নির্ধারন করে ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর উর্দ্ধোতন কতৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। পরে ২১ সালের নভেম্বর মাসের ১৮ তারিখে সড়ক ভবন থেকে অনাপত্তি পত্র চেয়ে চিঠি আসে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। চিঠি আসার সাত দিন পরে ঐ মাসের ২৭ তারিখে অনাপত্তি পত্র দেয়া হয়েছে। পরে আর কোন আপডেট আসেনি!
প্রকল্প সুত্রে জানাগেছে, ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার “ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়ককে ৪-লেনে উন্নীতকরণের জন্য মোট ১১ হাজার কোটি টাকার ডিপিপি প্রনয়ন এর কাজ শেষ হয়েছে। রোডের নকশার কাজ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এর মধ্যে ৫ টি ফ্লাইওভার রয়েছে এবং নড়াইল ও যশোর অংশে পৃথক ২ টি বাইপাস হবে। বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে ৯৫৯ দশমিক ৮৫ কোটি টাকা ব্যায়ে ৬ লেনের কালনা সেতু নির্মানসহ প্রকল্প এলাকায় আরও ৫টি ৬ লেনের ব্রীজের কাজ চলমান আছে। চার লেনে উন্নতিকরন প্রকল্পের অর্থের বিষয়ে বর্তমানে জি টু জি (সরকার টু সরকার ) আলোচনা চলছে।
সওজ ও পরিবহন সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানাগেছে, এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন হলে বেনাপোল-ঢাকার দূরত্ব ৮৬ কিলোমিটার কমবে। তখন রাজধাণী ঢাকার সাথে বেনাপোল স্থল বন্দের দূরত্ব হবে ২শ কিলোমিটার এবং ভারতের কোলকাতার দূরত্ব হবে মাত্র ২৮৪ কিলোমিটার। সড়কটি ব্যাবহার করতে পারলে পরিবহনযোগে রাজধাণী থেকে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টার মধ্যে পৌছানো যাবে বেনাপোল আর কোলকাতা যেতে সময় লাগতে পারে মাত্র ৪ থেকে ৫ ঘন্টা। একই ভাবে ঢাকার সঙ্গে শিল্প ও বাণিজ্যিক শহর নওয়াপাড়া ও মোংলা বন্দর, সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্য জেলার দূরত্বও কমে যাবে।
সওজ ও পরিবহন অফিস সুত্রে জানাগেছে, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে বেনাপোল এর দূরুত্ব (ভায়া নড়াইল) মাত্র ২শ কিলোমিটার। যার মধ্যে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে নড়াইল হয়ে যশোর বেনাপোল স্থলবন্দর পর্যন্ত সড়কটির দৈর্ঘ্য ১৩০ কিলোমিটার। ব্যস্ততম এই সড়কের প্রশস্থ মাত্র ১৮-২৪ ফুট। এই সড়ক দিয়ে ঢাকা বিভাগের ফরিদপুরের একাংশ, গোপালগঞ্জ এবং খুলনা বিভাগের বেনাপোল স্থল বন্দেরসহ ৯টি জেলার মোট ১১ জেলার যান চলাচল করে।
পরিবহন চালক রিপন মোল্লা জানান, বেনাপোল থেকে খুলনা হয়ে ঢাকার দুরত্ব ২৯০ কিলোমিটার। “ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়ককে ৪-লেনে উন্নীতি করলে তখন এই সড়ক দিয়ে বেনাপোল থেকে ঢাকার দুরত্ব হবে মাত্র ২শ কিলোমিটার। সড়কটি ব্যাবহার করতে পারলে ৮৬ কিলোমিটার পথ কমে যাবে। আর এক চালক টিপু সুলতান বলেন, বর্তমানে ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত পুরোনো এই সড়কের প্রশস্ত মাত্র ১৮ ফুট থেকে ২৪ ফুট! এই সড়কে ঝুকিপূর্ন কয়েকটি ১০-১৪ ফুট প্রশস্তের ব্রীজ রয়েছে, এই ঝুকিপূর্ন ব্রীজ দিয়ে ৫ টনের বেশি ওজনের গাড়ি উঠানো সরকারী ভাবেই নিষেধ। এতো পুরোনো কম প্রশস্ত সড়কে দুর্ঘটনা বাড়তে পারে সেই আশংকায় তারা সড়কটি ব্যাবহার না করে খুলনা ঘুরে বেনাপোল থেকে ঢাকা যাতায়াত করেন। ট্রাক চালক আলিম বলেন, “ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল সড়ককে ঝুকিপূর্ণ কয়েকটি ব্রীজ রয়েছে। এ সকল ব্রীজ দিয়ে তিন টনের বেশি ওজনের গাড়ি উঠানো ঝুকি। সেই জন্য তারা বেনাপোল থেকে অন্য (বিকল্প) সড়ক খুলনা, গোপালগঞ্জ হয়ে পদ্মা সেতু পার হয়ে ঢাকায় যাতায়াত করেন।
এদিকে ট্রাক চালক তজিবর শেখ জানান, পদ্মা সেতু চালু হলেও “ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়ককে ৪-লেনে উন্নীতকর না করায় এবং কালনা সেতু চালু না হওয়ায় অনেকে ভাঙ্গা-যশোর- বেনাপোল সড়ক ব্যাবহার না করে অনেক বেশি পথ ঘুরে আরিচা-দৌলতদিয়া ফেরি পার হয়ে ঢাকা যেতে হচ্ছে বেনাপোল স্থল বন্দরসহ খুলনা বিভাগের অন্তত ৬টি জেলার ভারি যান চালকদের।
নড়াইল জেলা বাস মিনি বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী জহিরুল হক বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এ (“ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল) সড়ক দিয়ে যানবাহনের চাপ অনেক বেড়ে গেছে। সড়ক সরু, ঝুকিপূর্ন ও নিম্নমানের হওয়ায় নড়াইল শহরের মধ্যে যানযট লেগেই থাকছে। দূর্ঘটনার আশংকা ও অনেক বেড়ে গেছে। প্রতিনিয়তই ঘটছে ছোট বড় দূর্ঘটনা। দ্রুত এ সড়কটি চার লেনে উন্নতি করনের দাবী জানান তিনি।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে সওজের এক কর্মকর্ত জানান, ভারত সরকার এ প্রকল্পে ১শ মিলিয়ন দিবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমরা চেয়েছি ১ হাজার মিলিয়ন। অর্থের বিয়য়টি কনফর্ম হলে দ্রুত এ কাজ শুরু হবে। তিনি আরও বলেন আরও দুটি দাতা সংস্থার সাথে কথা বলা হয়েছে তারাও চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ভারত সরকার যদি আমাদের চাহিদা মত অর্থ দিতে সম্মত না হন তাহলে আমরা এই (নতুন) দুটি দাতা সংস্থার সাথে কথা বলে ফান্ড কনফর্ম করবো। ফান্ড কনফর্ম হলে দ্রুতই কাজ শুরু হবে।
সওজ নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর “ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়ককে ৪-লেনে উন্নীতকরণ অতি জরুরী হয়ে পড়েছে। প্রকল্পের কাজ অফিসিয়ালি চলমান রয়েছে। বিষয়টি সরকার অনেক গুরুত্বের সাথে দেখছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকেই “ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল সড়কে গাড়ির চাপ অনেক বেড়ে গেছে। সড়কের আপাতত চাপসামলাতে কালনা থেকে যশোর পর্যন্ত বর্তমান সড়কটি আরও ছয় ফুট পিচঢালাই করে চওড়া করা হবে। দেড় বছরের মধ্যে এর কাজ শেষ হবে। “ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়ককে ৪-লেনে উন্নীতকরণের কাজ শুরু হলে ৫ বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। সড়কটি নির্মান হলে বেনাপোলের গাড়ি গুলো খুলনা ঘুরে না যেয়ে এ সড়ক ব্যাবহার করতে পারবে। বেনাপোলের সাথে ঢাকার দুরত্ব অনেক কমে যাবে। তখন পদ্মা সেতু পুরোপুরি সুফল পাবে এলাকাবাসী।
চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি দায়িত্বভার গ্রহন করে মাত্র চারদিন পর ১৬ ফেব্রুয়ারি সড়ক বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম মনির হোসেন পাঠান প্রকল্প এলাকা (ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল সড়কের) কালনা সেতু নির্মান কাজ পরিদর্শন করেন, সেতুর কাজ দ্রুত শেষ করার তাগিদ দেন। এসময় তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্রীজের কাজ শেষ করার জন্য সংশ্লিষ্ঠদের আহব্বান জানান ।
প্রসঙ্গত, গত ৭-৮ বছরে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রকল্প এলাকা (ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল সড়ক) ৩-৪ বার পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে কালনা ঘাটে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, কালনা সেতু পদ্মা সেতুরই একটা অংশ। পদ্মা এবং কালনা সেতুর মাধ্যমে বেনাপোল স্থলবন্দর-যশোর-নড়াইল-ভাটিয়াপাড়া-ভাঙ্গা-পদ্মা সেতু-মাওয়া-ঢাকা-সিলেট-তামাবিল সড়কের মাধ্যমে ‘আঞ্চলিক যোগাযোগ’ স্থাপিত হবে। প্রকল্প এলাকাসহ দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে।