হলি সিয়াম শ্রাবণ
শত বছরের বেশি সময় ধরে পতিত থাকা শক্ত জমিকে চাষযোগ্য করে কৃষিতে সফলতা অর্জন করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় যুবক আবুল ফজল (৪০)। কঠোর পরিশ্রম, আধুনিক পদ্ধতিতে সবজি চাষ ও অন্যান্য অর্থকরী কৃষিপণ্য উৎপাদন করে মাত্র দুবছরে এলাকার কৃষকের মাঝে রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন তিনি। কৃষিতে অবদানের জন্য ইতিমধ্যে তিনি পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। তাঁর সাফল্য দেখে স্থানীয় অনেক বেকার যুবক বর্তমানে কৃষিকাজে আগ্রহী হচ্ছেন।
আবুল ফজল ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার বোকাইনগর ইউনিয়নের বালুচড়া গ্রামের মোঃ আবুল কাইয়ুমের ছেলে। পেশায় তিনি ছিলেন একজন গার্মেন্টস কর্মী। মাসে বেতন পেতেন প্রায় ৫০ হাজার টাকা। করোনাকালে চাকুরী হারিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। পরবর্তীতে চাকুরীর পেছেনে না ছুটে সংসারের হাল ধরতে সিদ্ধান্ত নেন গ্রামে একটি কৃষি ফার্ম গড়ে তোলার। এ লক্ষে নিজের বাড়ির কাছে শত বছরের বেশি সময় ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা ২৭০ শতক জমি ইজারা নিয়ে ২০২০ সালে কৃষি কাজ শুরু করেন আবুল ফজল।
ইজারা নেয়া পরিত্যক্ত জমিটিতে ঘন জঙ্গল, প্রাচীন মাটির হাড়ি পাতিল ভাঙ্গা ও ইটের সুরকীতে পরিপূর্ণ থাকায় চাষাবাদের অনুপযোগী ছিল।
শক্ত মাটির এ জমিতে চাষাবাদের লক্ষে পরিস্কার করার সময় গ্রামের অনেক মানুষ মন্তব্য করেছিলেন এখানে কৃষি ফসল উৎপাদন সম্ভব নয়। মানুষের সমালোচনা কান না দিয়ে অদম্য আবুল ফজল কঠোর পরিশ্রম ও মেধা দিয়ে সেই জমিটিকে চাষযোগ্য করে তাতে গড়ে তুলেন নিজ নামে ফজল এগ্রো ফার্ম। আধুনিক পদ্ধতিতে শিম, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, তরমুজ, মাল্টা, কুমড়া, কমলা, শজনে, কাঁচা মরিচসহ বিভিন্ন সবজি চাষে সফলতা অর্জন করেন তিনি। সবজির পাশাপাশি শুরু তাতে করেন ঘাস চাষ ও বিভিন্ন সাথী ফসল উৎপাদন। এ ছাড়া তিনি আধুনিক পদ্ধতিতেক্যাপসিকাম, স্ট্রবেরিসহ বিভিন্ন ধরনের চারা উৎপাদন করেন এ ফার্মে।
বর্তমানে প্রায় ৩০০ শতক জমিতে এ কৃষি ফার্মটিতে ২০ জন শ্রমিক কাজ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন।
আবুল ফজলের চাষের বিশেষত্ব হচ্ছে, মৌসুম চলাকালীন তিনি সবজি চাষ করেন না। সংকটকালীন সময়ে সবজি চাষ করে তিনি আর্থিকভাবে অন্যান্য কৃষকের তুলনায় অধিক লাভবান হচ্ছেন। বর্তমানে আবুল ফজল এ ফার্ম থেকে খরচ বাদে মাসে আয় করেন থাকেন প্রায় ৮০ হাজার টাকা।কৃষি ফার্মের পাশাপাশি আবুল ফজল নিজ বাড়ির আঙিনায় গড়ে তুলেছেন একটি ছোট বিদেশী গরুর খামার। প্রথমে চারটি গরু দিয়ে শুরু করা এ খামারে বর্তমানে গরুর সংখ্যা চৌদ্দটি। প্রতি বছর গরু ও গাভীর দুধ বিক্রি করে লাভবান তিনি। এ গরুর খামারে সারা বছর গো-খাদ্যের চাহিদা মেটে কৃষি ফার্মে চাষকৃত ঘাস ও শজনে পাতা থেকে। নিজের গরুর খামারের চাহিদা মিটিয়ে কৃষি ফার্ম থেকে উৎপাদিত ঘাস ও ঘাসের কাটিং বিক্রি করে আয় করেন আবুল ফজল।
এছাড়া গরুর খামারের গোবর থেকে ভার্মি কম্পোস্ট পদ্ধতিতে উৎপাদিত জৈব সার নিজের জমিতে প্রয়োগ ও অন্য কৃষকের কাছে বিক্রি করেন তিনি।
কৃষিপণ্য উৎপাদনে চমক দেখানো সফল উদ্যোক্তা আবুল ফজল আধুনিক চাষাবাদে উৎসাহী করতে নিজ কৃষি ফার্মে গড়ে তুলেছেন কৃষকের পাঠশালা। এ পাঠশালায় প্রতিদিন ফ্রি কৃষি পরামর্শ নিতে আসেন স্থানীয় কৃষকরা। নিজ ফার্মে কৃষকদের হাতে-কলমে শিক্ষার পাশাপাশি বিনামুল্যে বিভিন্ন সবজির চারা ও ঘাসের কাটিং বিতরণ করেন তিনি।
আবুল ফজল জানান- আমাদের দেশের কৃষকরা সাধারণত সনাতন পদ্ধতিতে কৃষিপণ্য উৎপাদনের কারনে বেশি লাভবান হয়না। এক্ষেত্রে উৎপাদনকারীর চেয়ে মধ্যস্বত্বভোগী বেশি লাভ করে থাকেন। এজন্য অনেকেই চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে অধিক লাভবান হওয়া সম্ভব। তাই চাকুরির পেছনে না ছুটে বেকার যুবকদের আধুনিক কৃষি কাজে মনযোগী হওয়ার আহবান জানান এই সফল উদ্যোক্তা।
উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবদুল মতিন বলেন- অদম্য মনোবল, কঠোর পরিশ্রম ও আধুনিক প্রযুক্তিতে চাষাবাদের কারনে আবুল ফজল দ্রুত সময়ে কৃষিতে সাফল্য পেয়েছেন। বিশেষ করে সবজি চাষে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি ইতিমধ্যে এলাকায় কৃষকদের মাঝে রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তাঁর সাফল্য দেখার জন্য প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষকরা আসেন এই কৃষিখামারে।
উপজেলা কৃষি অফিসার লুৎফুন্নাহার জানান- আবুল ফজল একজন আদর্শ কৃষক। শত বছরের অধিক সময় পতিত থাকা জমিতে আধুনিক প্রযুক্তিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি ও অন্যান্য অর্থকরী ফসল চাষ করে ব্যাপকভাবে লাভবান হচ্ছেন। কৃষি বিভাগ থেকে তাঁকে পরামর্শের পাশাপাশি সহযোগিতা করা হচ্ছে। মাত্র দুই বছরে কৃষিতে সাফল্য অর্জন করায় গত বছর আবুল ফজল পান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের কৃষক পুরস্কার (প্রথম পুরস্কার)।