লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধঃ নিয়াজীর আত্মসমর্পণের পরে ভাটিয়াপাড়ার পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে

0
24
লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধঃ মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসলে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের চলাচল সীমিত হয়ে যায়
লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধঃ মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসলে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের চলাচল সীমিত হয়ে যায়

এ্যাডঃ আবদুস ছালাম খান, লেখক সিনিয়র আইনজীবী ও সাংবাদিক

৮ ডিসেম্বর লোহাগড়া থানা এবং ১০ ডিসেম্বর নড়াইল সদর থানা পাক দোসরদের হাত থেকে দখলমুক্ত করার মধ্য দিয়ে সমগ্র নড়াইল মহাকুমা (বর্তমানে জেলা) পাক হানাদার মুক্ত হয়। এরও আগে যশোর ক্যান্টনমেন্টও মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে এসেছে। কিন্তু এ অঞ্চলের একমাত্র পাক সেনাঘাঁটি ভাটিয়াপাড়া মিনি ক্যান্টনমেন্টের পাকসেনারা তখনও আত্মসমর্পণ না করে সেখানে অবস্থান করছিল। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় তাদের প্রধান সেনাপতি নিয়াজী (আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী) সদলবলে আত্মসমর্পণ করলেও এই মিনি ক্যান্টনমেন্টের সৈন্যরা তখনও আত্মসমর্পণ করতে রাজী হয়নি। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগণ পাক ক্যাম্প কমান্ডার মেজর শওকত হায়াত খানকে আত্মসমর্পনের জন্য বার বার অনুরোধ করে ব্যর্থ হন। তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে ছাড়া আত্মসমর্পণ করবে না বলে পাল্টা আল্টিমেটাম দিয়ে বসে থাকে। এদিকে যশোর থেকে লোহাগড়া পর্যন্ত শত্রুমুক্ত এলাকা হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ছিল অপরিসীম। তাছাড়া ইতিপূর্বের ন্যায় ভাটিয়াপাড়ার ওই ক্যাম্প আক্রমণ করলে এখন আর পাকসেনাদের সমর্থনে যশোর থেকে কোন যুদ্ধ বিমান উড়ে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর ব্রাশ ফায়ার করে বা বোমা ফেলে ছত্রভঙ্গ করে দিতে আসবে না। মুক্তিযোদ্ধারা এটা নিশ্চিত ছিল। কারণ যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখলের সাথে সাথে ওই যুদ্ধ বিমান গুলি ধংস হয়ে গেছে।

এ কারণে মুক্তিযোদ্ধারা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ওই মিনি ক্যন্টনমেন্ট দখলের পরিকল্পনা করে। কিন্তু পাকসেনাদের ওই ঘাঁটি এতটাই মজবুত ছিল যে তা ধংস করার মত অস্ত্র-শস্ত্র স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ছিল না। জঙ্গী বিমান থেকে বোমা ফেলানো ছাড়া স্থল যুদ্ধে তাদের উৎখাত করা সম্ভব ছিল না। তখন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগণ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নড়াইলে অবস্থানরত সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপটেন খন্দকার নাজমুল হুদার সাথে দেখা করে বিদ্যমান পরিস্থিতি তাঁকে অবহিত করেন।

উল্লেখ্য গোপালগঞ্জ মহাকুমার (বর্তমানে জেলা) অন্তর্গত কাশিয়ানী থানার ভাটিয়াপাড়া তৎকালে মধুমতি নদী তীরে অবস্থিত বিখ্যাত নদী বন্দর ও ফরিদপুর জেলার কালুখালি থেকে আসা রেল লাইনের সর্বশেষ রেল স্টেশন। এখানে একটি অয়্যারলেস স্টেশন ছিল। এই অয়্যারলেস স্টেশন ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছিল কুখ্যাত এই মিনি ক্যান্টনমেন্ট। মুক্তিযুদ্ধকালে ভাটিয়াপাড়া যশোরের সাথে অর্থ্যাৎ ৮নং সেক্টরের অধীনে ছিল। ক্যাপটেন কে এন হুদা ওরফে খন্দকার নাজমুল হুদা ৮নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমা›ডার ছিলেন।

ক্যাপ্টেন হুদা বিদ্যমান পরিস্থিতি শুনে নিজেই ভাটিয়াপাড়া অভিযানে আসতে সম্মত হন। তিনি সেক্টর কমান্ডারের সাথে যোগাযোগ করে লেঃ কমল সিদ্দিকীকে সাথে নিয়ে এবং ভাটিয়াপাড়া যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে ভাটিয়াপাড়া আসেন। নড়াইলের চিত্রা নদীতে এবং লোহাগড়ার নবগঙ্গা নদীতে তখন কোন ফেরি ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ কালে পাক সেনাদের অবাধ চলাচল ঠেকাতে ওই ফেরিগুলি ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল। ক্যাপটেন হুদা বিভিন্ন ভারী অস্ত্র-শস্ত্র ও সহযোগীদের নিয়ে লঞ্চ যোগে লোহাগড়া আসেন। তারা বর্তমান কালের লোহাগড়া প্রেসক্লাবের পূর্ব দিকে নদীর ঘাটে নেমে গরুর গাড়িতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ভাটিয়াপাড়া যান। মুক্তিবাহিনী প্রধান ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা ও লেঃ কমল সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ভাটিয়াপাড়া সেনাক্যাম্প মুক্ত করতে যাওয়া ওই সাঁজোয়া দলের লোহাগড়ায় আগমনের সে দৃশ্য আজো আমার মনে আছে।

তৎকালে লোহাগড়া বাজার থেকে কুন্দশী যাবার জন্য নবগঙ্গা নদীর পাড় দিয়ে পায়ে হাঁটা একটি রাস্তা ছিল। আমি সেদিন ওই রাস্তা দিয়ে বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। ওই সময়ে একখানি বড় লঞ্চ এসে থামলো। লঞ্চ দেখে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। লঞ্চ থামার সাথে সাথে অয়্যারলেস হাতে দুইজন কর্মকর্তা গোছের লোক নেমে পড়লেন। তাদের একজন অয়্যালেসের মাধ্যমে অপর কোন সেনাঘাঁটিতে তাঁদের আগমনের এবং অস্ত্র-শস্ত্র নামানোর ধারাবাহিক বিবরণ জানাচ্ছিলেন। আমি অস্ত্র-শস্ত্র নামানোর পুরো সময়টাই সেখানে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। পরে জেনেছিলাম ওই সেনা কর্মকর্তার একজন ক্যাপ্টেন হুদা এবং অপরজন লেঃ কমল সিদ্দিকী। তাঁদের নেতৃত্বেই লোহাগড়া ও গোপালগঞ্জ-কাশিয়ানী এবং আলফাডাঙ্গা অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা ভাটিয়াপাড়া পাকসেনা মুক্ত করেছিল।
ক্যাপ্টেন হুদা ভাটিয়াপাড়া পৌছে পাকসেনাদের সারেন্ডার করতে আল্টিমেটাম দেন। কিন্তু পাক সেনাদের ধারণা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সারেন্ডার করলে তাদের মেরে ফেলা হবে। তাই আল্টিমেটামের নির্দেশ পেয়েও তারা কোন সাড়া দেয়নি। ফলে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের উৎখাত করা ছাড়া আর কোন পথ থাকে না। ক্যাপটেন হুদা সব মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে একযোগে ভাটিয়াপাড়া আক্রমণ করেন। যুদ্ধ শুরুর ২য় দিনে লেঃ কমল সিদ্দিকীর চোখে পাক সেনাদের গুলি লেগে তিনি গুরুতর আহত হন। তাঁকে তাৎক্ষনিক যশোর পাঠানো হয়। উন্নত চিকিৎসার পরও তার সে চোখটি ভালো হয়নি বলে শুনেছি।

মুক্তিযুদ্ধকালে ভাটিয়াপাড়া ক্যাম্পের প্রধান ছিল মেজর শওকত হায়াত খান। কালনা যুদ্ধের সময় খিজির হায়াত ওরফে সাব্বির খান নামে একজন পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধৃত হয়ে বন্দী ছিল। প্রথমে মাইক দিয়ে এবং পরে এক পর্যায়ে ওই সৈনিককে ক্যাম্পে পাঠিয়ে পাক সেনাদের মারা হবে না এমন নিশ্চয়তা দিয়ে তাদের সারেন্ডার করতে বলা হয়। এভাবে একাধিকবার দ্যুতিয়ালীর পর অবশেষে ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভাটিয়াপাড়া ক্যাম্পের পাক সেনা কর্মকর্তা মেজর শওকত হায়াত খানসহ ৯৩ জন পাক সেনা (৯২ জন পাঞ্জাবী সৈন্য এবং ১ জন বেলুচ সৈন্য) এবং ৪৯ জন রাজাকার-আল শামস্ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপটেন এম এন হুদার কাছে আত্মসর্মপন করে। (তথ্য সূত্রঃ ভাটিয়াপাড়া অয়্যারলেস স্টেশনস্থ তৎকালীন পাকসেনা ক্যাম্পে নির্মিত স্মৃতি স্তম্ভ)।

আত্মসমর্পনকৃত পাকসেনাদের যশোর এবং রাজাকার-আল শামস্দের গোপালগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হয়। (তথ্যসূত্রঃ কাশিয়ানী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা স্মরণিকা, ২০১১)।এসময় ১ জন পাকিস্তানী আর্মি ‘হাম সারেন্ডার নেহি করেগা’ বলে নিজের রাইফেল থেকে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। ভাটিয়াপাড়া মিনি ক্যান্টনমেন্টের পাকসেনা ও তাদের দোসর রাজাকার-আলশাম্সদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চল হানাদার মুক্ত হয় এবং লোহাগড়ার মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তি ঘটে।

মুক্তিযুদ্ধকালে ভাটিয়াপাড়ার পাকসেনাদের অনেক অত্যাচার নির্যাতন ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ দেখেছি শুনেছি তাদের শক্তিশালী ওই ঘাঁটির কথা। তাই আত্মসমর্পণের ২ দিন পর স্বচক্ষে দেখতে গিয়েছিলাম কুখ্যাত সেই মিনি ক্যান্টনমেন্ট। সত্যিই ওখানে তারা ক্যান্টনমেন্টই বানিয়েছিল। সৈন্যদের থাকার জন্য মাটির তলায় বাঙ্কার খুঁড়ে তার উপর টিন দিয়ে উপরে বালির বস্তা সাজিয়ে নিরাপদ দুর্গ করেছিল। একইভাবে একটি দুর্গ থেকে আরেকটি দুর্গে যেতেও সুড়ঙ্গ পথ বানিয়েছিল। যুদ্ধকালীন কোন সৈনিকদের এমন ক্যান্টনমেন্ট দেখার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় ভাটিয়াপাড়ার ওই মিনি ক্যান্টনমেন্ট দেখে পাক সেনাদের সারেন্ডার না করার কারণ অনুমান করতে পেরেছিলাম। ভাটিয়াপাড়ার তৎকালীন অয়্যারলেস স্টেশন ঘিরে গড়ে তোলা কুখ্যাত সেই মিনি ক্যান্টনমেন্টের স্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করা হয়েছে। তবে সেই অয়্যারলেস টাওয়ারটি এখনও ভাঙ্গা অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে অয়্যারলেস ভবনটিও ব্যবহার অনুপোযোগি হয়ে গেছে।

উল্লেখ্য ঢাকায় নিয়াজী আত্মসমর্পণ করার পরপরই পাকিস্তানের রাস্ট্র ক্ষমতারও পালা বদল হয়। তৎকালীন পাকিস্তানের কুখ্যাত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ক্ষমতা হস্তান্তর করার পর পরই ইয়াহিয়া খানকে গৃহবন্দী করা হয় এবং তার সমস্ত খেতাব প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৮০ সালের ১০ আগস্ট তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে মারা যান।